reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

সাক্ষাৎকার

কম খরচে মানসম্মত সেবার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি

গবেষণার মাধ্যমে শিশু রোগের কার্যকর নতুন চিকিৎসা উদ্ভাবন করে, শিশুমৃত্যু কমিয়ে একটি সুস্থ জাতি তথা বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট। এটি ঢাকা শিশু হাসপাতাল নামে পরিচিত। এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক জাহিদুল ইসলাম

প্রতিদিনের সংবাদ : স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই হাসপাতালে অধিকাংশ রোগীকে অর্থের বিনিময়ে সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থ ব্যয় করলেও এখানকার টয়লেট-বাথরুম ব্যবহার উপযোগী নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

ড. জাহাঙ্গীর আলম : এই হাসপাতালে আমি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যতগুলো সংকট দেখেছি তার মধ্যে অন্যতম বাথরুম সংকট। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্বজন ও অভিভাবকদের জন্য এখানে বাথরুমের সংকট প্রকট। হাসপাতালের শুরু থেকেই নারী-পুরুষের আলাদা বাথরুম ছিল না, পুরুষ-মহিলা একই বাথরুম ব্যবহার করেন। এমনকি ডাক্তারদের জন্যও নেই আলাদা ব্যবস্থা। জায়গা সংকটে একজন সহকারী অধ্যাপককে এখনো রুম দিতে পারিনি। জায়গা সংকট দূর করতে আমরা চারতলা একটি ভবন নির্মাণ করছি। ওটার নিচতলায় এক পাশে হবে রান্নাঘর, বাকি পুরোটা হবে পাবলিক টয়লেট। আবার ভর্তি হওয়া রোগীদের বাবা বা নিকটাত্মীয়রা প্রয়োজনে যেকোনো সময় হাজির থাকতে ঝোপের মধ্যে বা রাস্তায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমায়। তাদের জন্য মসজিদের পাশে অত্যাধুনিক শেড নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে ফ্যান, মোবাইল চার্জিং, ব্যাগেজ রাখা ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। নামমাত্র মূল্যে তারা এখানে থাকতে পারবেন। হাসপাতালের জায়গা সংকট দূর করতে বেদখল হয়ে যাওয়া ৬ দশমিক ২ একর জমি ব্যবহার করব। কিন্তু এখনো সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এটার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কাজটা করতে হবে।

প্রতিদিনের সংবাদ : এখানে দালাল চক্রের একটা দৌরাত্ম্য আছে বলে শোনা যায়। বিষয়টা কতটুকু সত্য এবং সত্য হলে এর বিরুদ্ধে আপনার পদক্ষেপ কী?

ড. জাহাঙ্গীর আলম : আমার জানা মতে একসময় এখানে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ছিল, তবে বর্তমানে নেই। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যখন রোগীরা এখানে আসেন তাদের অনেকে সঠিকভাবে অবস্থান না জানার কারণে অন্য কারো শরণাপন্ন হয়। এ ছাড়া শয্যা সংকটে আমাদের এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ৩০ জন মুমূর্ষু রোগী অন্য সরকারি হাসপাতালে রেফার করতে হয়। যে রোগীগুলো ফেরত যায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্লিনিকের দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে। এটা যেন না হয় সেজন্য আমাদের এখানে একটি ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার সেন্টার হচ্ছে। সেখানে অত্যাধুনিক ইমার্জেন্সি সুবিধাসহ ২০টা বিছানা থাকবে। এরই মধ্যে এর নকশা হয়েছে এবং পিডব্লিউডি থেকে সম্ভবত টেন্ডারও হয়ে যাবে, এটা হয়ে গেলে আশা করি এ সমস্যা থাকবে না। এ ছাড়া হাসাপাতালকে অটোমেশন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে রোগীরা হাসপাতালে না এসে ঘরে বসে পেমেন্ট ও ডাক্তারের সিরিয়াল দিতে পারবেন। এতে রোগীরা সুশৃঙ্খলভাবে সেবাও পাবে এবং হাসপাতালের ভিড়ও কমবে। এভাবে দালাল চক্রের যতটুক দৌরাত্ম্য আছে তাও থাকবে না বলে আশা করি।

প্রতিদিনের সংবাদ : বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কি পর্যাপ্ত আছে?

ড. জাহাঙ্গীর আলম : অবজারভেশন বেড, পালস অক্সিমেটার, ইসিজি মনিটরসহ ভেন্টিলেটর, সিপিএপি, হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাসহ যেসব সরঞ্জামাদি দরকার তার প্রায় সবই আছে। ইনকিউবেটর যেসব ওয়ার্ডে দরকার সেখানে আছে। এসব নিয়ে আমাদের এখানে কোনো সমস্যা নেই।

প্রতিদিনের সংবাদ : আমরা জানি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটিও (বিএসএমএমইউ) স্বায়ত্তশাসিত। কিন্তু সেখানকার তুলনায় এখানে চিকিৎসা সেবার ব্যয় অনেক বেশি বলা হচ্ছে।

ড. জাহাঙ্গীর আলম : বিএসএমএমইউয়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আমরা এটাকে তৈরি করতে চাচ্ছি। তারা যেমন খরচ নেয়, আমরাও সেরকমই নেব। আমাদের এখানে নতুন সংযোজিত একটা ইইজি মেশিন, একটা ইএমজি মেশিন রয়েছে এগুলো আগে ছিল না। আমি আসার পর ইএমজি আর নার্ভ কনডাকশন ভ্যালোসিটি মেশিন নতুন সংযোজন করেছি। এসব মেশিনের সেবামূল্য আমরা বিএসএমএমইউয়ের সঙ্গে মিল রেখেই নির্ধারণ করেছি। যেহেতু আমরা একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল, সরকার আমাদের বেতন ভাতাদি খাতে যে থোক বরাদ্দ দেয় তাতে বেতন-ভাতার অর্ধেকও হয় না। কিন্তু এই হাসপাতালের বিশাল খরচ আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই করতে হয়। তাই আমরা ইচ্ছা করলেই হঠাৎ সেবা মূল্য কমাতে পারছি না। আমাদের বার্ষিক বাজেটের ৩০ শতাংশেরও কম সরকার থেকে বরাদ্দ দেয়। সরকার যদি আমাদের জন্য বরাদ্দ অনুদান বাড়িয়ে দেয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই এখানকার সেবামূল্য কমে যাবে আশা করি।

প্রতিদিনের সংবাদ : পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর উল্লেখযোগ্য কী কী কাজ করা হয়েছে?

ড. জাহাঙ্গীর আলম : আমি এখানে পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর নিউমোনিয়া রিসার্চ সেন্টার, নিউমোনিয়া ওয়ার্ড, রেস্পাইরেটরি আইসিইউ, ব্রঙ্কোসকপি মেশিন স্থাপন করেছি। একটি ফিজিওথেরাপি সেন্টার করেছি ও একটি মডিউলার অপারেশন থিয়েটার হচ্ছে। আবার রোশ বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে একটি নিউরোলজি সেন্টার তৈরি করা হচ্ছে। অত্যাধুনিক মডেল ফার্মেসি করেছি। কনভেনিয়েন্ট স্টোর করেছি। টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে সবকিছুর সংস্কার করেছি। হাসপাতালে আগে যে জরাজীর্ণ অবস্থা ছিল সেখান থেকে এখন একটি পরিচ্ছন, ঝকঝকে পরিবেশ তৈরি করেছি। হাসপাতালের মসজিদটি আগে ভাঙাচুরা ছিল। অজু করা যেত না, ভেতরে এসি ছিল না। এখন সেই মসজিদ সংস্কার করেছি, অজুখানা তৈরি করে ভেতরে এসির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন আমি একটা বোর্ডরুম করতে চাচ্ছি, আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের জন্য একটি আলাদা রুমের ব্যবস্থাসহ। আমাদের ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সের কাজটি হয়ে গেলে এখানকার ইমার্জেন্সি সেবার মান অনেক উন্নত হবে। ঢাকা শিশু হাসপাতাল এক্সটেনশন প্রজেক্ট-১-এর মাধ্যমে আমাদের সি ব্লকের তিনতলা পর্যন্ত কাজ হয়ে গেছে এখন এর ১০ তলা পর্যন্ত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল এক্সটেনশন প্রজেক্ট-২ এর কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সানুগ্রহ কামনা করছি। এ ছাড়া এখানে চারতলা একটা স্টিলের ইনফ্রাস্টাকচার হচ্ছে।

প্রতিদিনের সংবাদ : হাসপাতাল ঘিরে আপনার পরিকল্পনা কী বা এটাকে কেমন দেখতে চান ভবিষ্যতে?

ড. জাহাঙ্গীর আলম : আমি আগামী দিনগুলোতে এই হাসপাতালকে ১ হাজার ৫০০ শয্যায় উন্নীত এবং চূড়ান্তভাবে দুই হাজার শয্যায় রূপান্তর করতে চাই। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বর্তমানে একটি বড় পেডিয়েট্রিক হাসপাতাল হলো বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল। আমার লক্ষ্য একটাই, এখানে মানুষ আসবে সেবা নিতে নির্দ্বিধায়। আমরা সরকারি হাসপাতালের খরচে যেন করপোরেট হাসপাতালের মতো সেবা দিতে পারি। এ ব্যাপারে দরকারি সহযোগিতার জন্য সরকারের কাছে আমার বিনীত আবেদন থাকবে।

প্রতিদিনের সংবাদ : অনেক সময় শোনা যায় হাসপাতালে ওষুধ সংকট। অথচ এখানে রোগীদের ফ্রি ওষুধ দেওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে ওষুধ সংকট হলে একজন গরিব রোগীর জন্য তা বাইরে থেকে কেনা কষ্টকর। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

ড. জাহাঙ্গীর আলম : এখানে ফ্রি ওষুধ দেওয়ার যে বিষয়টি বললেন তা পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা ফ্রি বিছানাগুলোতেই শুধু ফ্রি ওষুধ দেই। কিন্তু যেসব বিছানায় পেয়িং রোগী থাকে সেগুলোতে ফ্রি ওষুধ দেওয়া হয় না। তাদের খাবারও দেওয়া হয় না। শুধু চিকিৎসাসেবাটাই দেওয়া হয়। এ ছাড়া এখানে অপারেশনের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অনেক কম ব্যয় হয়। আর ফ্রি বিছানার রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ পুরোটাই ফ্রি। কিন্তু কিছু কিছু দামি ওষুধ যেগুলো আমাদের এখানে পাওয়া যায় না, সেগুলো তাদের বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। এ ছাড়া শিশুসহ মায়ের তিন বেলা খাবার, দুধ, এসব বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ডেঙ্গুর সময় সব ডাক্তার তাদের এক দিনের বেতন দিয়ে রোগীদের জন্য ওষুধ কিনেছেন। এখানে স্যালাইন, অ্যালবুমিন, ইমোনোগ্লোব্লিন কোনো কিছুরই সংকট হয়নি। আমাদের হাসপাতালে একটা থিরাপিউটিক প্লাজমা এক্সচেঞ্জ মেশিন, ফেনো মেশিন, সুয়েট ক্লোরাইড আয়নটোফরসিস মেশিন নতুন সংযোজন করা হয়েছে। জাপান সরকারের সহায়তায় আরো কিছু মেশিন অচিরেই সংযোজিত হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close