নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

হলফনামায় সম্পদের ঘোষণা

কারো বেড়েছে ৪১ গুণ, কারো ৭

সংসদ সদস্যদের মধ্যে গত ১৫ বছরে কেউ হয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক; কারো সম্পদ বেড়েছে ৪১ গুণ, কারো ৭। আবার কারো সম্পদ এবং ঋণ দুটোই বেড়েছে। তবে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাড়াদের সংখ্যাই বেশি। আসন্ন দ্বাদশ-নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা ঘেঁটে জানা গেছে এ তথ্য।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী গত ১৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। সামশুল হক বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি হলেও এবার তাকে মনোনয়ন দেয়নি দল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়েছেন।

তার হলফনামা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের চেয়ে সামশুল হক ও তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪১ গুণ। একইসঙ্গে নিজের আয় বেড়েছে প্রায় ২১ গুণ। ২০০৮ সালে প্রাইভেট কার ব্যবহার করলেও বর্তমানে সামশুল হক প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল ল্যান্ড ক্রুজারে যাতায়াত করেন।

অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৪১ গুণ : ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সামশুল হক চৌধুরী অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন ২১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬৯ টাকার। আর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে উল্লেখ করেছেন ৫ কোটি ৪১ লাখ ১৯ হাজার ৫৯০ টাকার। এ ছাড়া ১০ হাজার ৩২ দশমিক ৭ ইউএস ডলার আছে। তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ ১৭ হাজার ১৭২ টাকার। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় স্ত্রীর কোনো অস্থাবর সম্পত্তি ছিল না। সেই হিসাবে এই দম্পতির অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪১ গুণ।

এছাড়া ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত দশ বছরে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে সাত গুণ বেড়েছে। একই সময়ে তার স্ত্রীর আয়ও বেড়েছে তিন গুণ। এর পাশাপাশি ২০১৪ সালের আগে নজিবুল বাশারের স্ত্রী ও তার দুই ছেলের কোনো গাড়ি ছিল না। এখন তারা চারটি গাড়ি ব্যবহার করেন। নজিবুল নিজেও ব্যবহার করেন দুটি গাড়ি।

২০১৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় নজিবুল বশর তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৫৩৫ টাকা। ২০২৩ সালের হলফনামায় এই আয় দেখানো হয়েছে ৫৪ লাখ ৩৭ হাজার ৬২৭ টাকা। এই আয় তার ২০১৮ সালের হলফনামায় দেখানো আয়ের চেয়ে দেড়গুণ বেশি।

এদিকে, চট্টগ্রাম-৭ (বাঙ্গুনিয়া) আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ আছে। দুটি ব্যাংক থেকে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও জামানতবিহীন ৯১ লাখ ঋণ এবং ভাইদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তার কাছে নগদ টাকা আছে ৫ লাখ ১০ হাজার, স্ত্রীর আছে ৪০ হাজার টাকা।

তথ্যমন্ত্রীর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর নামে ৫ লাখ ১৫ হাজার। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার আছে ৭ লাখ ১২ হাজার ২৫০ টাকার। নিজের ৫ ভরি এবং স্ত্রীর ৫০ ভরি স্বর্ণও রয়েছে। আর ৭০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ৪৫ হাজার টাকার আসবাবপত্র আছে।

বছরে সাকিবের আয় সাড়ে ৫ কোটি টাকা, ব্যাংক ঋণ ৩২ কোটি : মাগুরা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সাকিব আল হাসান হলফনামায় বার্ষিক গড় আয় দেখিয়েছেন ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭১ হাজার ২৬২ টাকা। জামানতের বিপরীতে ব্যাংক লোন দেখিয়েছেন ৩১ কোটি ৯৮ লাখ ৬১ হাজার ৩৮২ টাকা।

রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবু নাসের বেগ জানান, হলফনামায় সাকিব পেশায় নিজেকে একজন ক্রিকেটার উল্লেখ করেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবিএ পাস। সাকিব বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৫ কোটি ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৯ টাকা। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে ব্যাংক জমা দেখিয়েছেন ১১ কোটি ৫৬ লাখ ৯১ হাজার ৮৭৬ টাকা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ৪৩ কোটি ৬৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৭৪ টাকা। স্বর্ণ দেখিয়েছেন ২৫ ভরি। আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক্সসামগ্রী দেখিয়েছেন ১৩ লাখ টাকা। আয় থেকে ব্যাংক আমানত দেখিয়েছেন ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৯৩ টাকা।

বেড়েছে মোমেন ও ইমরানের সম্পদ, কমেছে নাহিদের : সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুুল মোমেনের বার্ষিক আয় কমেছে ৯ লাখ ৭০ হাজার ১৯৫ টাকা। তবে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫০৬ টাকার। তার স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৫৭ লাখ ৫১ হাজার ৭১০ টাকার। স্ত্রীর নামে আগে ১৩ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল, এখনো ততটুকুই আছে।

অন্যদিকে, সিলেট-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের বার্ষিক আয় বেড়েছে ১৪ লাখ ৮৮ হাজার ৮২৮ টাকা। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৪ কোটি ৫২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭১ টাকার। স্ত্রীর নামে অস্থাবর সম্পদ ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৩ টাকা দেখিয়েছেন।

আর সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বছরে আয় দেখিয়েছেন ৫০ লাখ ৩০ হাজার ১১৩ টাকা, যা গত নির্বাচনে দেখিয়েছিলেন ৩২ লাখ ১০ হাজার ৪১০ টাকা। অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ১ কোটি ৯ লাখ ৯৩ হাজার ১৩২ টাকার। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯ টাকা। এবার স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ২২ লাখ ২৮ হাজার ৪৪০ টাকার। গত নির্বাচনে স্থাবর সম্পদ দেখান ৬৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪০ টাকার।

বিপুল সম্পদ সালাম মুর্শেদীর : পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪৩ কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী আবদুুস সালাম মুর্শেদীর। ২০১৮ সালের হলফনামায় তার সম্পদ ছিল ৯৫ কোটি ১১ লাখ টাকার। তবে পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকায়। আয়ও বেড়েছে। আগে বার্ষিক আয় ছিল ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এখন ৮ কোটি ২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তার ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার। এখন ২৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার।

সম্পদ কম, ঋণ বেশি নারায়ণ চন্দ্রের : সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবারও খুলনা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০১৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। প্রতি বছর কৃষি খাত থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ইটভাটার ব্যবসা থেকে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং সংসদ সদস্য হিসেবে ৬ লাখ ৬০ হাজার আয় করেন তিনি। ২০১৮ সালে তার সম্পদ ছিল ৬৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকার। পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

১৫ বছরে লতিফের অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ১৮ গুণ, আয় ১২ গুণ : ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম-১১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম এ লতিফের অস্থাবর সম্পত্তি (নগদ টাকা, স্বর্ণ) ছিল ৩০ লাখ ২ হাজার ৬৯১ টাকা। বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ১৮ হাজার টাকার। এবার অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭০৬ টাকা এবং বার্ষিক আয় ৭৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। টানা তিনবার জয়লাভ করা এই সংসদ সদস্যের ১৫ বছরের ব্যবধানে অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ১৮ গুণের বেশি এবং বার্ষিক আয় ১২ গুণের বেশি বেড়েছে।

ভূমিমন্ত্রীর আয় দ্বিগুণ : গত ১৫ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বার্ষিক আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে বার্ষিক আয় ৭৪ লাখ ১২ হাজার ৯৭ টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে ৮৩ হাজার টাকা, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান বা অন্য ভাড়া থেকে ৫৮ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৯ টাকা, ব্যবসা থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০ টাকা, চাকরি থেকে ১২ লাখ ৬০ হাজার এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫০ হাজার ৪১৮ টাকা। ২০০৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ৩৫ লাখ ৩২ হাজার ৩০৮ টাকা।

সম্পদ বেড়েছে এম এ লতিফের : চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গা) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এম এ লতিফের সম্পত্তি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৮ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তার অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকায়। ৫ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। পরিমাণে কম হলেও স্থাবর সম্পত্তিও বেড়েছে।

৫ বছরে মাত্র ১৩ হাজার টাকা আয় বেড়েছে এমপি খোকার : টানা দুবারের এমপি। তারপরও আয় কমেছে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের লিয়াকত হোসেন খোকার। স্ত্রীর একই অবস্থা। বাড়ি বা দোকানভাড়া থেকে তার আয় বেড়েছে মাত্র ১৩ হাজার টাকা। তবে আয় কমলেও ৮৫ লাখ টাকায় গাড়ি কিনেছেন এমপি লিয়াকত হোসেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টির এ সংসদ সদস্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছেন।

৫ বছরে ফারুক চৌধুরীর ব্যাংকে জমা ৯ কোটি টাকা, বেড়েছে সম্পদও : রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংকে আগে এক টাকাও ছিল না। কিন্তু এখন আছে ৯ কোটি টাকা। আর নির্ভরশীলদের নামে ২০১৮ সালে জমি না থাকলেও এবার হয়েছে ৬০ বিঘা।

সম্পদ কমেছে শামীম ওসমানের, বেড়েছে ঋণ : নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। গত ৫ বছরে তার সম্পদের পরিমাণ কমেছে, বেড়েছে ঋণ।

হলফনামায় উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে শামীম ওসমানের নামে ১০ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল। যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৮ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৭ টাকায়। বন্ধু ও ব্যাংকের কাছে একক ও যৌথভাবে তিনি দেনা ও ঋণ আছেন ২২ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ টাকা। ৫ বছর আগে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৭ হাজার ৮১৭ টাকা। তবে ব্যবসা খাতে তার আয় সামান্য বেড়েছে। গতবার ব্যবসা খাতে তার আয় ছিল ২২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, যা এবার কিছুটা বাড়িয়ে ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫২ টাকা দেখানো হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close