নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩

হরতাল-অবরোধে জীবিকায় টান

টানা হরতাল অবরোধের বেড়াজালে জীবিকায় টান পড়েছে শ্রমজীবী মানুষের। তাদের অনেকে ঘরে বসে রোজগারহীন দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও সাধারণের চাওয়াটাও খুব বেশি কিছু নয়, দিন শেষে একটুখানি শান্তির ঘুম। দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটে মাশুল দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিগত বেশ কয়েক মাস ধরেই উত্তপ্ত কিন্তু গত এক মাসে কয়েক দফা হরতাল আর অবরোধের প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে মারাত্মকভাবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক মাসে তাদের ক্ষতি ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে এবং কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে ব্যবসায়ীরা এখন আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর গত এক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার যে প্রভাবের কথা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তা প্রকৃতপক্ষে কতটা ব্যাপক?

ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকায় একটি কনফেকশনারি দোকানের মালিক রুহুল আমিন বলেন, গত মাসে ঘনঘন হরতাল-অবরোধের কারণে তার বিক্রি কমে গেছে। আগে প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ হাজার টাকার কেনাবেচা হতো, এখন তা কমে এসেছে তিন হাজারের কোঠায়।

নিকটবর্তী খিলগাঁও এলাকার একজন মুদি দোকানদার বলেন, বিক্রি কমে গেছে, যে পরিস্থিতি তাতে ব্যবসার লালবাতি জ্বলতে বাকি নেই।

অনেক ব্যবসায়ীই বলছেন, লাভ তো দূরের কথা এখন পুঁজিতেই টান পড়েছে অনেকেরই।

ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র পুরোনো শহরের বাদামতলী, ওয়াইজঘাট, আর সোয়ারীঘাট। নানা রকমের কাঁচামাল, চাল-ডাল, শাকসবজি, পেঁয়াজ-রসুনের মতো মশলা আর ফলমূলের একটি বড় অংশই সরবরাহ হয় এখানকার আড়তগুলো থেকে। সেখানে ঘুরেও দেখা গেল একই রকম চিত্র। বাদামতলীতে কয়েকজন কাঁচামাল ব্যবসায়ীকে দেখা গেল, তারা ক্যারম খেলছেন।

এখানে একটি চালের আড়তে কথা হচ্ছিল ব্যবসায়ী লাল মিয়ার সঙ্গে। তার কথায়, ব্যবসায় ধস নেমেছে। ভয়ে লোকজন আসছে না। আজ সারা দিনে এক বস্তাও চাল বিক্রি হয়নি। দোকানের শাটার খুললেই যেখানে দুই হাজার টাকা দৈনিক খরচ সেখানে ২০০ টাকাও আয় করতে পারিনি।

বাদামতলীর আরো কয়েকজন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হলো। সবাই বলছেন অপূরণীয় ক্ষতির কথা। কারো ক্ষতি হাজারের অঙ্গে, কারো লাখের অঙ্গে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই অনেক দিন আগে থেকেই বলে আসছে, একদিনের হরতালেই ব্যবসা-বাণিজ্যে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তবে এখন এফবিসিসিআই সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, তারা ক্ষতির হিসাব করা ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের কথা কে শুনছে? অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে- যা আমরা টাকার হিসেবে মেলাতে পারব না। মেলানো সম্ভব না। অতএব এটা করে কি হবে?

এদিকে, নির্বাচনী উত্তাপে সড়ক-মহাসড়কজুড়ে শঙ্কা কখন যেন কোথা থেকে কী হয়? অগ্নিসংযোগে জীবন পুড়বে নাকি ভাঙচুরে ক্ষতবিক্ষত? এসবই যেন এখন হরতাল কিংবা অবরোধের সমার্থক শব্দ। শুধু একটি দিন নয়, একটি ঘণ্টাও যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে এসব কর্মব্যস্ত মানুষ তবে নিদারুণ হয়ে ওঠে যাপিত জীবন। উপার্জনের বিপরীতে বোঝা তখন কপালে চিন্তারেখা, শূন্য দৃষ্টি আর অভুক্ত পেট।

সাধারণ মানুষ জানান, রাজনীতি থাকলে থাকবে রাজনৈতিক কর্মসূচিও। তবে তা যেন না হয় সামগ্রিক ক্ষতি। এছাড়াও সংলাপে সংঘাত কতটুকু এড়ানো যেত সে আলোচনাকে পিছিয়ে রেখে শান্তিপ্রিয় জনগণ রাজনীতির চেয়ে এগিয়ে রাখলেন দেশনীতিকেই।

তাদের ভাষ্য, রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের জন্য, জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য বাড়ানো জন্য নয়। উৎসবমুখর নির্বাচনী সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে, যে নির্বাচনে সব দল সমানভাবে অংশ নিতো এবং ভোট হতো শান্তিপূর্ণ।

রাজধানীর ডেমরায় কথা হয় অটোরিকশাচালক মুরাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তায় কোনো যাত্রী নেই। মানুষ আতঙ্কে ঘর থেকে বের হয় না। আর বের হলেও তারা অটোরিকশায় উঠতে চায় না।

মুরাদ বলেন, আগে জমা ছিল ৮০০ টাকা, হরতাল অবরোধে সেই জমা কমে ৪০০ টাকা করেছে মহাজন। কিন্তু সেই টাকা তুলতেই মাথার ঘাম ছুটে যায়। খালি গাড়ি নিয়া ঘুরছি, কোনো যাত্রী পাচ্ছি না। আগে ৮০০ টাকা জমা করেও ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়া বাড়ি গেছি। আর এখন জমা ৪০০ টাকা দিয়া কোনো দিন ৪০০, কোনো দিন ৬০০ টাকা বাড়ি নিয়ে যাই। এই ট্যাকায় কিছুই হয় না, জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে, বাজারে গেলে মাথাঘোরে। গরিব মানুষের কথা রাজনৈতিক দলের নেতারা ভাবেন না। ভাবলে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিত না।

সাধারণ মানুষের অভিমত, দেশ আর দশের স্বার্থেই ঐক্যের প্রয়োজন, যেন ভবিষ্যৎটা ঝুলে না থাকে শঙ্কার ফাঁদে। এছাড়াও দাবি আদায়ে প্রয়োজন রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিন্নতা, এড়াতে হবে রাজনৈতিক সংকট। তবেই হয়তো ফের উৎসবের রং ফিরে পাবে জাতীয় নির্বাচন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় চলাচলরত বাস-মিনিবাসের মালিকের সংখ্যা ৩ হাজারের মতো। এসব মালিকরা সবাই চলমান অবরোধ ও হরতালের ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত পড়ে পড়েছেন। তারপরও নিরূপায় হয়েই রাস্তায় বাস নামাতে হচ্ছে। বাস না নামালে যেমন মালিকরা পথে বসবে, তেমনি বিভিন্ন যানবাহনের হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিক অনাহারে দিন কাটাবে। এসব বিবেচনা করেই তারা রাস্তায় বাস নামাচ্ছেন। ফলে নগর পরিবহনের শ্রমিকরা কিছুটা ভালো থাকলেও দূরপাল্লার পরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের অবস্থা আরো খারাপ। ৬০ শতাংশ দূরপাল্লার বাস চলাচল একেবারেই বন্ধ। রাজধানীর টার্মিনালগুলো ফাঁকা। বাস চালানোর প্রস্তুতি নিলেও যাত্রী না পাওয়ায় বাস চলাচল করতে পারছে না। শুধু হরতাল বা অবরোধের দিনই নয়, আগের দিন থেকে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। গত শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পোড়ানো শুরু হয়। গুলিস্তান ও আগারগাঁওতে দুটি বাসে আগুন দেয় হরতাল সমর্থকরা। ব্যস্ততম দুই সড়ক মুহূর্তে খালি হয়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, অটোরকিশা, পিকআপ দুষ্কৃতকারীদের মূল টার্গেটে পরিণত রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close