বদরুল আলম মজুমদার
আন্দোলনের এক মাস
কী পেল বিএনপি?
শুরুটা হয়েছিল গত ২৯ অক্টোবর। আগের দিন ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার প্রতিবাদে সেদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল দিয়েছিল বিএনপি। এরপর থেকে শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার ছাড়া টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে দলটি। কিন্তু সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেও তাতে বৈচিত্র্য আসেনি। উল্টো বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় কর্মসূচিই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের বেশিরভাগ কার্যালয়ই বন্ধ হয়ে আছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দলটিতে। তারা বলেছেন, সব আন্দোলন-কর্মসূচিই চলছে বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে। ফলে কর্মসূচিগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ এবং তার জোটসঙ্গী ও মিত্ররা ভোটমুখী। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবং বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। ওইদিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের এক সদস্যসহ দুজন নিহত হন। এরপর পুলিশ সারা দেশে ধরপাকড় শুরু করে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সক্রিয় কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই কারাগারে। জেলা পর্যায়েও সক্রিয় নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারে, বেশিরভাগ আত্মগোপনে।
অথচ কর্মসূচির সূচনালগ্নে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এক মাস নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, যারা দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, মানুষের ভোটাধিকারে বিশ্বাসী যারা সরকার পতনের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নেমেছেন, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত কারো ঘরে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি দ্রুত রাজপথে ফয়সালা করতে চাই। এখন থেকে আগামী একটি মাস আপনারা প্রস্তুত থাকবেন, যখন যে ডাক আসবে, সে ডাকে সাড়া দেবেন। নিজ নিজ এলাকায় প্রস্তুত থাকবেন, যত কঠিন হোক প্রস্তুত থাকবেন। কিন্তু সেই ডাকে সাড়া পড়েনি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশনির্ভরতা গণতন্ত্র ও ওই দলের জন্য সুফল আনতে পারে না। পাশাপাশি সরকারপক্ষের এ সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না, যেন দেশের নির্বাচনের মতো অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে কাউকে সুযোগ করে দেওয়া। তিনি আরো বলেন, এখন আমাদের অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিজেদের শক্তিরই জানান দেওয়া উচিত।
গত বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কলাপসিবল গেট দিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি বাংলা সংবাদপত্র দেওয়া এবং একটি চেয়ার রয়েছে সেখানে। সামনের ডেস্ক ও চারপাশ ধুলার পুরু স্তরে ঢেকে গেছে। দলটির ডাকা দেশব্যাপী অবরোধ চললেও আশপাশে কোনো নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। বিএনপির নেতাকর্মীরা বলেন, কার্যালয় ঘিরে পুলিশ পাহারা। গেলেই গ্রেপ্তারের ভয় আছে। ফলে কার্যালয় খোলা হয় না।
বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশ পাহারা নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি-আওয়ামী লীগ প্রত্যেকটা পার্টি অফিসের সামনে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ ফোর্স থাকে। সবসময়ই এখানে আলাদাভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেহেতু এটা বড় রাজনৈতিক দল, অনেক ধরনের সিচুয়েশন হয়, সেজন্য সবসময় নিরাপত্তা থাকে। এটা প্রচলিত। দীর্ঘদিন ধরেই এভাবে চলে আসছে। তবে শুধু কেন্দ্রীয় কার্যালই নয়, ৬৪ জেলায় খোঁজ নিয়ে এবং দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিদিনের সংবাদের প্রতিনিধিরা জানান, দলটির ৫৬ জেলা কার্যালয়ই বন্ধ। চারটি জেলায় দলের কার্যালয়ই নেই। খোলা আছে চারটি। যে চার জেলায় বিএনপির কার্যালয় খোলা পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো- ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর। তবে এসব কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের আনাগোনা খুবই কম। জেলা পর্যায়ের নেতারা বলেন, গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা সেখানে যান না।
মাগুরা : ২৮ অক্টোবরের পর থেকে জেলা কার্যালয় বন্ধ। তবে মাঝে তিন দিন অল্প সময়ের জন্য খোলা হয়েছিল।
খুলনা : শহরের কে ডি ঘোষ রোডে মহানগর ও জেলা বিএনপির কার্যালয়। সেটি এক মাস ধরে তালাবদ্ধ।
নড়াইল : জেলা কার্যালয়টি তিন মাস ধরে বন্ধ বলে দাবি করেছেন দলের নেতারা। তারা বলেন, বিগত ৫ বছরে চারবার কার্যালয়টি খোলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কার্যালয় খোলা হয়।
ফেনী : ২৮ অক্টোবরের পরও শহরের ইসলামপুর সড়কে জেলা কার্যালয় খোলা ছিল। তবে বন্ধ হয়ে যায় ১১ নভেম্বর থেকে। এছাড়া নোয়াখালী জেলা কার্যালয়ও বন্ধ।
ঠাকুরগাঁও : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের জেলার কার্যালয় খোলা। সেখানে পুরুষ নেতাকর্মীরা যান না বললেই চলে। তবে মাঝেমধ্যে নারী নেতাকর্মীরা যান, মিছিলও করেন।
পঞ্চগড় : জেলা কার্যালয় খোলা থাকে। কর্মসূচি উপলক্ষে সেখানে নেতাকর্মীরা যান।
কুষ্টিয়া : জেলা কার্যালয় সকাল ও বিকেলে দুই দফায় কয়েক ঘণ্টার জন্য খোলেন একজন কর্মী। তবে কোনো নেতাকর্মী সেখানে যান না।
মেহেরপুর : কার্যালয় খোলা থাকে। তবে সারির নেতারা আত্মগোপনে। এদিকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের দাবি, এক মাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ হাজার ৩২৬ জনকে। এক সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হয়েছেন বলেও দাবি করেছে সংগঠনটি। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ হলে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল লিখিত বক্তব্যে এ দাবি করেন। লিখিত বক্তব্যে কায়সার বলেন, গত ২৮ অক্টোবর সরকারি দলের পরিকল্পিত সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনাবলীর পর এ পর্যন্ত ৮৩৭টির বেশি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৭৩ হাজার ১২৩ জনকে। আর ২০ হাজার ৩২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান এ বিষয়ে বলেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর এত মামলা ও অত্যাচার আগে কখনো দেখিনি। গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ভয়ে নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। তবে কাজ করছেন। এ অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। এদিকে সমমনা দলগুলোর শীর্ষনেতারাও কেউ আত্মগোপনে, আবার কেউ নীরব আছেন। সমমনা জোটে থাকা শরিক দলের একজন শীর্ষনেতা বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোটের আরো কয়েকটি দলও চাপের মধ্যে রয়েছে। তাদেরও নির্বাচনে নেওয়ার জন্য নানা প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। তবে বিএনপি থেকে সাহস ও শক্তি পাচ্ছেন তারা।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, পাঁচণ্ডছয় জায়গা থেকে আহ্বান এসেছিল নির্বাচনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না এলডিপি। ভাগাভাগির কোনো নির্বাচনে যাবে না। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হলে সেই নির্বাচনে যাবে। বেঈমানি করবে না। মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্য এলডিপি রাজনীতি করে না, দেশের জন্য রাজনীতি করে। মানুষের জন্য কাজ করতে চায়। বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচিগুলোয় সঙ্গে থাকবে এলডিপি। গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক নুর জানান, তাদের ওপরও চাপ আছে। কিন্তু যত চাপই থাকুক না কেন, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
"