গাজী শাহনেওয়াজ

  ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত

এডিসের প্রজনন বেড়েছে শীতে মিলবে সুফল

* চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে * মশকনিধন অভিযান শিথিল হওয়ার কারণে প্রকোপ এখনো আছে * তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটের নিচে নামলে মশার প্রজনন কমবে

ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব চলতি নভেম্বরে কমার কথা থাকলেও আক্রান্ত ও মৃত্যু অব্যাহত আছে। দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাব্যবস্থা আধুনিক মানসম্পন্ন না হওয়ার কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন। এডিস মশার আক্রমণ থেকে বাঁচতে নিজে সচেতন হতে হবে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। তারা আরো বলেন, প্রজনন বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব কমতে সময় লাগবে। ঝাঁকিয়ে শীত নামলে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটের নিচে নামবে, তখন মিলবে সুফল। এডিস মশার প্রজনন প্রাকৃতিকভাবেই কমবে। হ্রাস পাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যু।

পরিসংখ্যান দেখে তারা বলছেন, সম্প্রতি এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু আবার কিছুটা বেড়েছে। অক্টোবরে কিছুটা কমেছিল। তবে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যুতে সিটি করপোরেশনগুলোর মশা নিধন অভিযান কিছুটা শিথিল হওয়ার কারণে প্রকোপটা বর্তমানে ঊর্ধমুখী। গত সোমবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৯ হাজার ৮৭। এ বছর মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে ১৬০৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে সোমবারে ঢাকা সিটিতে ৪ এবং সিটির বাইরে থেকে ৪ জনসহ ৮ জন মারা গেছেন। রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইইডিসিআর) সাবেক উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মিধিলের সঙ্গে বৃষ্টিপাত ঘটেছিল। এটার প্রভাব পরবর্তী এক মাস সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। নভেম্বর মাস শেষ। কিন্তু এখনো শীতের দেখা নেই। আর এখানে এত বেশি শীত পড়ে না, ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব কমবে। কারণ এডিস মশার প্রকোপ নির্মূল হওয়ার জন্য ১৫ সেন্টিগ্রেট মাত্রায় শীত নামতে হয়, যা বাংলাদেশে কখনোই হয় না। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গু বাড়বে। আর এডিস মশা কামড়ালে ১৫ দিন পর্যন্ত ঝুঁকি থাকে। বেশি আক্রান্ত হলে সুস্থ হতে এক মাসও লেগে যেতে পারে। এর মধ্যে কাউকে বাঁচাতে পারব কাউকে পারব না।

দীর্ঘদিন ধরে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব থাকলেও মৃত্যু কেন কমছে না, জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ এ গবেষক বলেন, আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ডায়নামিক না। বর্তমানে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কম আছে। তবে একেক হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের চিত্র ভিন্ন। তাই যারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের ত্রুটি রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কী করতে হবে তারা জানেন, কিন্তু কার্যকরী ব্যবস্থা নেন না বলেই সমস্যাটা বাড়ে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আরো বেশি সিরিয়াস হওয়া দরকার। তাহলে ডেঙ্গুতে যে মৃত্যু ঘটছে কমবেশি যাই হোক শূন্যের কোটায় নেমে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে জানান, ডেঙ্গু মোকাবিলায় ভ্যাক্সিন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। যতদিন পর্যন্ত ভ্যাক্সিনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটছে না, ততদিন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তবে রোগীদের ধরন অনুসারে চিকিৎসা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বিএসএমএমইউয়ের এ চিকিৎসক বলেন, জটিলতা দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে এলে মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব। ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশি বেশি তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি দেশব্যাপী জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ চূড়ায় উঠেছিল সেপ্টেম্বর মাসে। তবে অক্টোবরে যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি কমেনি। নভেম্বরে আশা করেছিলাম কমবে। কিন্তু এখনো মৃত্যু কমেনি। ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব এখনো আছে। তাই এখনো এ ব্যাপারে ঘা-ছাড়া ভাব দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। সবাই স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। মশকনিধনের কাজ চালাতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক উত্তম বড়ুয়া এ ব্যাপারে বলেন, আমরা যদি নিকট অতীতে দেখি, গত বছরের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল। যদি আর কয়দিন পরে ডিসেম্বর মাস শুরু হবে। এর আগেই অর্থাৎ চলতি নভেম্বরে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব বেশি আছে। কারণ দেশের ঋতুবৈচিত্র্য অনুযায়ী অক্টোবরে শেষ হয় বর্ষা মৌসুম। এবার নভেম্বরেও ঝড় ও বৃষ্টির দেখা মিলেছে। মশার প্রজনন ক্ষেত্র বেড়েছে এবং তাদের প্রজননের জন্য আমাদের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রাও অনুকূল। এটাও বাড়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, যদি ডিসেম্বরে শীতের প্রকোপ বাড়ে এডিস মশার বংশ বিস্তার কিছুটা কমতে পারে। এজন্য অবহেলা করা যাবে না। আর নির্বাচনের মৌসুম চলছে। এ কারণে সিটি করপোরেশনগুলো মশকনিধন অভিযান কার্যক্রমে কিছুটা শিথিলতা আমরা দেখতে পারছি।

এর আগের ৫ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৯ সালে ১ লাখ ডেঙ্গু রোগী দেখেছিল বাংলাদেশ; আর কোনো বছরেই এত রোগী হাসপাতাল ভর্তি হতে দেখা যায়নি। ৩ বছর পর ২০২২ সালে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রাণ হারিয়েছিল ২৮১ জন, যেই সংখ্যার চারগুণ মৃত্যু গত অক্টোবর মাসেই দেখেছে বাংলাদেশ। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর মশাবাহিত বিভিন্ন রোগে বিশ্বে ৭ লাখ মানুষ মারা যান। ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগ বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এ রোগের ব্যাপকতা ২০১৯ সালে দেখা যায়। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close