মিজান রহমান

  ৩০ নভেম্বর, ২০২৩

বিনা ভোটে জয় ঠেকাতে কৌশলী আ.লীগ

বিএনপি ও আরো কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে থাকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় ঠেকাতে এক আসনে নিজেদের একাধিক প্রার্থী রাখার সুযোগ রেখেছে ক্ষমতাসীন দলটি।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটার প্রতিফলন ঘটাতে চান এবার নির্বাচনে। তিনি বলেছেন, সব দল বিষয় নয়, জনগণ নির্বাচনে অংশ নিলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। তাই এবার নতুন কৌশল নেওয়া হয়েছে। এর কারণ, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার আশঙ্কা দূরে রাখা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের অর্ধেকের বেশি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হন- এবার যেন সেই পরিস্থিতি না হয়।

এছাড়া দলটি মনে করছে, প্রার্থী বেশি হলে জনপ্রিয় প্রার্থী মাঠে থাকে, এতে ভোটার উপস্থিতিও বেশি হবে। ফলে ভোটকেন্দ্রে ভোটাররের উপস্থিতিই আওয়ামী লীগের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটি নতুন রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে। সে কৌশলের পুরোটা তো প্রকাশ করা যাবে না। তবে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা যায়। আমরা এবার চাই নির্বাচন যেন উৎসবমূখর পরিবেশে হয়। নির্বাচনে প্রার্থী যত বেশি হবে ভোটারদের নির্বাচনে আগ্রহ তত বাড়বে। ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি তত বাড়বে। আমরা চাই ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে যায়।

তবে সভাপতি শেখ হাসিনার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী হওয়াদের কারণে তৃণমূলে কোন্দল এবং নির্বাচনের সময় সংঘাত, সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মনোনয়ন ঘোষণার পর দেশের কয়েকটি এলাকায় হামলা ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। তবে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিশহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর রহমান মনে করেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা না থাকলেও শেখ হাসিনা তো নৌকার প্রার্থীদের জন্য ভোট চাইবেন। সেভাবে নির্দেশনাও আসবে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সেটা বুঝতে হবে। আশা করি সংঘাত হবে না।

এ বিষয়ে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আশা করি, দলের স্থানীয় পর্যায়ে কোন্দল বা সংঘাত হবে না। আমাদের নজর থাকবে। তবে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ফেসবুক লাইভ করে আলোচিত হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েও প্রার্থী হওয়া ব্যারিস্টার সৈয়দ ছায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকলেও আমি প্রধানমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কথায় আস্থা রাখতে চাই। তারা বলেছেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন হবে। আর আমরা নির্বাচিত হলে তো আওয়ামী লীগেই থাকবো।

ব্যারিস্টার সুমন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা। এবার তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়ে পাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি তো নৌকার প্রার্থী। মনোনয়ন পাইনি। প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমি সেই সুযোগ নিয়েছি। আরো অনেকেই নিচ্ছেন। যদি ঠিকমতো ভোট হয়, তাহলে এবার জানা যাবে আওয়ামী লীগ যাদের মনোনয়ন দেয় তারা পপুলার, না দলে তার বাইরেও আরো পপুলার প্রার্থী আছে। আমার মনে হয়, অনেক পপুলার প্রার্থী, যারা মনোনয়ন পাননি, তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও পপুলার প্রার্থীদের কারণে নির্বাচন জমে যাবে।

এদিকে, শুরুতে বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে যারা পাবেন না তারা আর প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ডামি প্রার্থীর সিদ্ধান্ত দেওয়ায় দলে যেন ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীর ঢল নেমেছে।

ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। এ আসনে ১১ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক।

এ কে আজাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- যারা দলের মনোনয়ন চেয়েছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের লোক। যারা মনোনয়ন পায়নি, তারা যদি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন, তাহলে দলের আপত্তি নেই। উৎসাহ দেওয়ার কথা বলেছেন।

শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে এবং কারুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব হবে না। আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতারাও আছেন। ফরিদপুরের শিল্প, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানে আমার কিছু বিশেষ পরিকল্পনা আছে। এরই মধ্যে আমি বেশ কিছু কাজ করেছি। আরো কাজ করার জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, এবারের নির্বাচনে একটি অভিনব পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনে নেই। ফলে এবার দলীয়ভাবেই আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে নির্বাচনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাতে হয়ত নৌকা প্রতীক আর স্বতন্ত্র মিলিয়ে আওয়ামী লীগেরই এক আসনে একাধিক প্রার্থী থাকবে। কিন্তু এটা তো নদীর স্বাভাবিক গতি নয়। গতি আনার চেষ্টা। সব দল নির্বাচনে থাকলে তার উত্তেজনা, আগ্রহ আলাদা। এভাবে নির্বাচনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে কিনা- তা নির্বাচন হলেই দেখা যাবে।

এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, এবার একাধিক প্রার্থী নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কোন্দল ও সংঘাত ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দেখেছি সংঘাত হয়েছে। কারণ, গত ১৫ বছরে ভোট, রাজনীতি কেমন যেন হয়ে গেছে। সব দল নির্বাচনে এলে ভালো প্রার্থী পাওয়া যায়। ভোটারদের আগ্রহ থাকে। এবার এ অভিনব পরিস্থিতিতে কী ফল আসে দেখা যাক।

এবার আওয়ামী লীগ থেকে ৩০০ আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিন হাজার ৩৬২ জন। প্রতি আসনে গড়ে প্রার্থী ছিলেন ১১ জন। এর মধ্যে ২৯৮ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। ফলে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী মনোনয়ন না পেয়ে যেমন হতাশ হয়েছেন, তেমনি প্রধানমন্ত্রীর কথায় ‘স্বতন্ত্র’ বা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হতে উৎসাহিতও হয়েছেন। এখন এমন কোনো আসন নেই যেখানে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় প্রার্থী নেই। কোনো কোনো আসনে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীও আছেন। তবে আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। আগামীকাল বোঝা যাবে এবার কতজন প্রার্থী হবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close