বিশেষ প্রতিবেদক

  ২৮ নভেম্বর, ২০২৩

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন

বিয়োগের তালিকায় সমালোচিতরা

কেউ ছিলেন গণবিচ্ছিন্ন, কারোর বিরুদ্ধে ছিল এন্তার দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ, কারোর ভূমিকা দলের নীতি ও কৌশলের বিরুদ্ধে ছিল। এসব বিভিন্ন কারণে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি প্রভাবশালী বহু প্রার্থী। দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা ঘরে নৌকার জয় আনতে সমালোচিতদের বিয়োগের তালিকায় রেখেছেন, নতুন ও অপেক্ষাকৃত বেশি ভোট টানতে পারবে এমন ব্যক্তিদের নৌকার মাঝি হওয়ার মনোনয়ন দিয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তাই তিনজন প্রতিমন্ত্রীও বাদ পড়েছেন। কিন্তু কেন তারা তাদের অবস্থান ধরে রেখে এবার মনোনয়ন পাননি- এ নিয়ে আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। তবে মনোনয়ন না দেওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টরা যৌক্তিক কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, বিতর্কিতদের বেশির ভাগই মনোনয়ন পাননি।

প্রতিমন্ত্রী হলেও মনোনয়ন পাননি ময়মনসিংহ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম খালিদ, খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এবং কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

বিভিন্ন কারণে সমালোচিত-আলোচিতদের মধ্যে যারা মনোনয়ন পাননি তাদের মধ্যে খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মুরাদ হাসান, পঙ্কজ নাথ, জাকির হোসেন, সাইফুজ্জামান শিখর, নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের মতো নেতারাও রয়েছেন।

এসব প্রার্থী মনোনয়ন না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সংসদীয় এলাকায় তাদের অনুসারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের অনুসারীরা খুলনা-৩ আসনের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন। ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে মনোনয়ন না পাওয়ায় কে এম খালিদের অনুসারীরা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে কে এম খালিদকে এবার নৌকার মাঝি করা হয়নি। তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার মুখে। কিছু নেতাকর্মীও তার বিপক্ষে আছেন। কে এম খালিদের বদলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আবদুল হাই আকন্দকে। আকন্দ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জানতে চাইলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম খালিদ গতকাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেছেন, মনোনয়ন না পেলেও তার কোনো মন্তব্য নেই। তবে তিনি নৌকার বিরুদ্ধে লড়বেন না। দলের সিদ্ধান্তকে তিনি মেনে নিয়েছেন বলে জানান।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন খুলনা-৩ আসন থেকে। এই আসন থেকে এবার নৌকার মাঝি হতে পারছেন না মন্নুজান। ফলে তার অনুসারী-সমর্থকরা বিক্ষুব্ধ। ওই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন এস এম কামাল হোসেন। প্রতিমন্ত্রী মন্নুজানের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়াও নানা অভিযোগ রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর ছোট ভাইকে নিজের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ও ভাতিজিকে মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় তহবিলে সহকারী পরিচালক (এডি) পদে চাকরি দেন। এরপর থেকে সমালোচনা বাড়তে থাকে। বলা হচ্ছে আত্মীয়স্বজনদের অনিয়মের জেরে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েন শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান।

গত রাতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমি এই আসনে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আমার নাম নেই। এ আসনে অন্য একজন মনোনয়ন পেয়েছে। আমার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তা মিথ্যা। আমি অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধ করার জন্যই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। আমি নৌকার বিরুদ্ধে কখনোই যেতে পারব না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিতর্কিত মন্তব্য ছুড়ে বার বার সমালোচনার জন্ম দিতেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। নিজের সংসদীয় আসনে অনুসারীদের অনেকেই তার ওপর নাখোশ। অবস্থা এমন যে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দলীয় সভাপতির কাছে আবেদন করেছিলেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনের রৌমারী, চিলমারী ও রাজিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ১৬ নেতা। তারা প্রতিমন্ত্রী জাকিরকে দুর্নীতিবাজ, গণবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে অভিযোগ আনেন। কুড়িগ্রাম-৪ আসনে এবার নৌকার মাঝি আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. বিপ্লব হাসান। মনোনয়ন না পাওয়া জাকির হোসেন অবশ্য নিজের বিরুদ্ধে শোনা সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। গতকাল রাতে বার বার তাকে ফোন করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পরপর দুই মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য খোন্দকার মোশাররফ হোসেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা ছাড়াও অনিয়মণ্ডদুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে রয়েছে তাকে। কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও তিনি সমালোচিত হন। ফরিদপুর-৩ আসনে এবার নৌকার হাল ধরছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক।

হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনে এবার মনোনয়ন পাননি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ। পরপর দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ১০ বছরে তার অনুসারীদের অত্যাচারের কারণে তিনি সমালোচনা ও বিতর্কে জড়ান। এই আসনে নৌকার হাল ধরছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও একাদশ সংসদের সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে জর্জরিত হন। ব্যাংকটি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। এটি বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কচুয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত চাঁদপুর-১ আসনে এবার তিনি মনোনয়ন পাননি পেয়েছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।

বার বার সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন জামালপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। তারকাদের সঙ্গে তার অশ্লীল ফোনালাপ ফাঁস হলে তিনি বিপাকে পড়েন। মন্ত্রিসভা থেকে তাকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হন। পরে দলের পদও তাকে ছাড়তে হয়। পরে এলাকায় জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি নৌকার মনোনয়ন পাননি। জামালপুর-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান।

মাগুরা-১ আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন পাননি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখর। বহিষ্কৃত যুবলীগ নেত্রী পাপিয়াকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় মানবজমিনের সম্পাদক ও আলোকচিত্রী শফিকুল ইসলাম কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি।

মানিকগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় মনোনয়ন পাননি আওয়ামী লীগের। দুর্জয় ও তার ঘনিষ্ঠদের স্বজনপ্রীতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ে অভিযোগ উঠে। বিভিন্ন সমালোচনার জেরে দুর্জয় মনোনয়ন হারান বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সালাম।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম এবার মনোনয়ন পাননি। তার নির্বাচনী এলাকা সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে এবার নৌকা পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম। তিনি উল্লাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। তানভীর ইমামের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দলীয় কর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা-১৩ আসনে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পান মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা সাদেক খান। ২০১৮ সালে এমপি হওয়ার পর রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিসংলগ্ন প্রধান বেড়িবাঁধ সড়কের দুই পাশের সরকারি জায়গা দখল করে ভাড়া দেওয়া, চাঁদাবাজি ও ছেলে ফাহিম খানের আধিপত্য এসব বিষয়ে তিনি বার বার সমালোচনার মুখে পড়েন। এবার এ আসনে তার বদলে নৌকার মাঝি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।

অস্ত্রধারী নিয়ে মিছিল করে সমালোচিত কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম এবার নৌকার মাঝি হতে পারছেন না। এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দীন আহমদ।

সুনামগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন (রতন) হাওরে সন্ত্রাস কায়েম করেছেন। এ কারণে তার বদলে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ চন্দ্র সরকারকে। রতন ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের করেছেন। এ অভিযোগ দুদকে রয়েছে। এজন্য জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রতনকে তলব করেছিল দুদক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close