জাহিদুল ইসলাম

  ২৩ নভেম্বর, ২০২৩

বিমা খাতে ঘুষ-দুর্নীতি অসহায় গ্রাহক

দেশের বিমা খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে ২০১০ সালে বিমা আইন এবং বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা হয়। তবে দীর্ঘ এক যুগেও বিমা খাতে অনিয়ম, ঘুষ গ্রহণ ও গ্রাহক হয়রানি দূর করতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। বরং এ দীর্ঘসময়ে সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিদের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আইডিআরএকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে নাজুক পরিস্থিতি। গ্রাহক পাচ্ছেন না তাদের বিমা-দাবির টাকা। তারা হয়ে পড়েছেন অসহায়। এ নিয়ে খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যেও চরম ক্ষোভ ও হতাশা আছে। দেশের বিমা খাতে চলছে তুঘলকীকাণ্ড। এতে গ্রাহক যেন অসহায়।

জানা গেছে, বিমা খাতে অনিয়ম দূর ও গ্রাহক হয়রানি বন্ধে সাবেক বিমা অধিদপ্তরকে বিলুপ্ত করে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠন করে সরকার। এর আগে বিমা আইন-২০১০ প্রণয়ন করে। খাতের উন্নয়নে গঠন করা হলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংস্থাটির শীর্ষ থেকে মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে হরহামেশাই। প্রথম চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদ এবং সর্বশেষ পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধেও অনিয়মণ্ডদুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যদিও পূর্ববর্তী চেয়ারম্যানদের তুলনায় বর্তমান চেয়ারম্যানের বিষয়ে অভিযোগ তুলনামূলক কম। কিন্তু অনিয়মকে প্রশ্রয়দানের অভিযোগ রয়েছে এ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এমন অনেক ঘটনাই বেরিয়ে এসেছে প্রতিদিনের সংবাদের অনুসন্ধানে।

যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামরুল হাসানসহ ৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ৯৩ গ্রাহকের প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে আইডিআরএর পক্ষ থেকে তদন্তের কথা বলা হলেও তার ফল কী, তা এখনো জানতে পারেননি ওই গ্রাহক। এছাড়া কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না হলেও তাকে অনুমোদন দিয়েছে আইডিআরএ। এছাড়া বিমা খাতের কয়েকটি কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এদিকে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লাখ লাখ গ্রাহক বিমা-দাবির টাকা উত্তোলনে ধারাবাহিক হয়রানির শিকার হলেও এ নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষুব্ধ গ্রাহক ও উন্নয়ন কর্মীরা কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্ধশতের বেশি মামলা করেছেন। এসব মামলায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বরং এরই মধ্যে সানলাইফের অধিকাংশ শেয়ার পরিচালকরা বিক্রি করে দিয়েছেন আরেকটি বিমা কোম্পানির কাছে।

বিমা খাতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ বিধিমালায় কোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও বা অন্য নির্বাহী কর্মকর্তারা একইসঙ্গে আরেক কোম্পানির পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারবেন না- এ বিধান থাকলেও তা মানেনি পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের (বিআইএফ) প্রেসিডেন্ট বিএম ইউসুফ আলী এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিব মোস্তফা হেলাল কবির। তারা উভয়েই এনআরবি ইসলামী লাইফের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। বিষয়টি জানার পরও এ নিয়ে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

একসময়ের দেশীয় বৃহৎ জীবন বিমা কোম্পানি ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও আপেল মাহমুদের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রতারণা অভিযোগ। ভুয়া এনজিওর সঙ্গে জড়িত হয়ে চাকরি দেওয়ার নামে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির কাছ থেকে হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অথচ অভিযোগ পাওয়ার পরও এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আপেল মাহমুদের প্রতারণার শিকার রাজধানীর নাখালপাড়ার স্কুলশিক্ষিকা আরাবিয়া আক্তার এখন স্বামী ও সংসারহারা। আরেক জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান প্রটেক্টিভ ইসলামী লাইফে আইন ভঙ্গ করে পরিচালক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আইনানুসারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপিদের বিমা কোম্পানির পরিচালক না করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি প্রটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক মাহজাবিন মোরশেদের ক্ষেত্রে। বিষয়টি জেনেও পদক্ষেপ নেয়নি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, অযোগ্যতার কারণে অনুমোদন না পাওয়া ও জরিমানার কবলে পড়া চতুর্থ প্রজন্মের একটি জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে গত মে মাসে অনুমোদন দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ অনুমোদনেও বিমা খাতের সাবেক সিইও এবং বর্তমানে আইডিআরএর এক সদস্যের হাত রয়েছে। অনুমোদনের বিনিময়ে ওই সদস্যকে আমেরিকায় ভ্রমণের ব্যবস্থাসহ একটি আইফোন উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এছাড়া ওই সদস্যদের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছে আরেকটি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি সচিব। বিমা খাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা গ্রাহক হয়রানি বন্ধ করতে না পারলেও অনেক কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানি সচিবের দায়িত্বে থাকা জহির উদ্দিনকে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে নির্দেশ দেয় আইডিআরএ। অথচ নিয়মানুসারে বিধিবদ্ধ পদ ব্যতীত কোম্পানির অভ্যন্তরীণ অন্যান্য দায়িত্বের বিষয়ে এমন নির্দেশনা দিতে পারে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিমাশিল্পে কেমন প্রভাব পড়ছে, তা জানতে চাওয়া হয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চতুর্থ প্রজন্মের দুই সিইওর কাছে। তারা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আইডিআরএ হলো শক্তের ভক্ত নরমের যম। আপনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কয়েকজনকে যত বেশি ঘুষ দিতে পারবেন, তত বেশি আপনার পক্ষে কথা বলবে। আবার অনেক বিমা মালিকদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ থাকায় পদোন্নতির জন্যও তারা ওইসব কোম্পানির পক্ষে কথা বলে। তাদের হাজারটা সমস্যা থাকলেও তা দেখে না। ফারইস্ট, সানফ্লাওয়ার, বায়রা, গোল্ডেন, সানলাইফের মতো কোম্পানি যারা লাখ লাখ বিমা গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না তাদের কিছু বলছে না। কিন্তু যারা কমপ্লায়েন্স মানেন, তাদের সামান্য এদিক সেদিক হলেই তলব, তদন্ত, শোকজ করে হয়রানির ওপরে রাখে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত এসব অভিযোগের বিষয়ে আইডিআরএর মুখপাত্র ও নন-লাইফ অনুবিভাগের পরিচালক উপসচিব জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আইডিআরএর আগের চেয়ারম্যানদের মতো বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। আমরা যথাযথভাবে আইন পরিপালনের চেষ্টা করছি। এ সময় এক কোম্পানির শীর্ষ পদে কর্মরত থেকে আরেক কোম্পানির পরিচালক হওয়া, ঋণখেলাপিদের বিমা কোম্পানির পরিচালক হওয়া, সার্টিফিকেট জালিয়াতির পরও মুখ্য নির্বাহী পদে অনুমোদন পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আইন লঙ্ঘন করে কেউ পরিচালক হলে সেটা আমরা দেখব। এখনো এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। তাছাড়া যেটা আগেই বলেছি, আমাদের লোকবল সংকট আছে। তাই যত ডকুমেন্টস আমাদের কাছে আসে, সব হয়তো সঠিকভাবে দেখা সম্ভব হয় না। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close