নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ছড়াচ্ছে চোখ ওঠা হ্যান্ড ফুট মাউথ

সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রামক জীবাণু। এতে ছোঁয়াচে বাড়ছে চোখ ওঠা রোগ। এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে। সতর্ক না হলে এ রোগ থেকে কর্ণিয়ার আলসার ও অন্ধত্বের মতো গুরুতর অবস্থাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই অবস্থা হ্যান্ড ফুট মাউথ রোগ নিয়েও। এটি নতুন করে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, হ্যান্ড ফুট মাউথ ছোঁয়াচে অসুখ। কোনো শিশু এতে আক্রান্ত হলে তাকে স্কুলে পাঠানো যাবে না। পরিবারের মধ্যেও এক ধরনের আইসোলেশনে তাকে রাখতে হবে।

‘হ্যান্ড ফুট মাউথ’ কেন হয় ও কীভাবে ছড়ায় : বারডেম হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, কক্সেকি নামের এক ধরনের ভাইরাসের কারণে মূলত এ রোগ হয়। এতে আক্রান্ত শিশুর নাকের পানি, লালা, ফোসকা ফাটা পানি, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে, এমনকি আক্রান্ত শিশুর পায়খানার মাধ্যমেও অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। ভাইরাসটি শিশুর শরীরে প্রবেশের চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা যায়। এ ছাড়া খেলনা বা দরজার নক বা অন্য আসবাবেও ভাইরাস অবস্থান করতে পারে এবং এগুলো কেউ স্পর্শ করলেও সে আক্রান্ত হতে পারে। যেসব জায়গায় জনসমাগম বেশি যেমন স্কুলে একটি শিশু আক্রান্ত হলে তার কাছ থেকে এ ভাইরাস অতি দ্রুত অন্য অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ আক্রান্ত হলে প্রথম সপ্তাহেই ভাইরাসটি অন্যের মধ্যে বেশি ছড়ায়।

জটিলতা : তেমন কোনো মারাত্মক জটিলতা না থাকলেও মুখে ও গলায় ব্যথা, খেতে না পারার কারণে কখনো কখনো শিশুর শরীরে পানির ঘাটতি হতে পারে। খুবই কম হলেও কখনো কখনো এই ভাইরাস মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সংক্রমণ করতে পারে। এ ছাড়া অনেক সময় হাত বা পায়ের আঙুলের নখ পড়ে যেতে পারে, যা অবশ্য অল্প দিনের মধ্যে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

জ্যেষ্ঠ শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘মুখ গহ্বরে হলেই শিশুদের বেশি কষ্ট হয়। এ সময়টাতে শিশুদের খেতে অসুবিধা হয়। খাবার গিলতে ব্যথা লাগে।’ সাধারণত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এ রোগ হয়। বর্ষা মৌসুমেই এর প্রকোপ বাড়ে বলে জানান চিকিৎসকরা। পাঁচ বছর আগে এর বেশি বিস্তার ঘটেছিল বলে স্মরণ করতে পারেন অধ্যাপক সহিদুল্লা। এরপর এ বছর বেশি হার ঘটছে, বিশেষ করে রাজধানীতে। তবে দেশের অন্য স্থানেও এটি ছড়ানোর আশঙ্কা আছে।

চিকিৎসা : বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই বা তার দরকারও নেই। সাধারণত ৭-১০ দিনের মধ্যে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। স্বাভাবিক পরিচর্যা, খাবার, বিশেষ করে পানি বা পানীয় পর্যাপ্ত দিতে হবে, যাতে প্রস্রাব ঠিকমতো হয়। ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার বিশেষ করে ফলের রস মুখের ব্যথা বাড়াতে পারে। জ্বর থাকলে নির্দিষ্ট মাত্রার প্যারাসিটামল দেওয়া যাবে, তবে অ্যাসপিরিন দেওয়া ঠিক হবে না। এর বাইরে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই এবং অহেতুক এগুলো দেওয়ার দরকার নেই।

চোখ ওঠা : জুলাই থেকেই এ রোগের বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। সেপ্টেম্বরে এসে বেড়েছে প্রকোপ। একসঙ্গে খেলাধুলা ও সতর্কতা ছাড়াই সংস্পর্শে আসার কারণে শিশুদের রোগটি বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

সম্প্রতি বান্দরবান ভ্রমণ করে ফিরেছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান। থাকেন মেসে। তিনি জানান, বান্দরবান থেকে বাসায় আসার পর থেকেই দেখেন চোখ জ্বালা করছে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়নায় দেখেন চোখ লাল হয়ে আছে, ফুলে গেছে চোখের পাতা। পরে একে একে মেসে থাকা আটজনের মধ্যে পাঁচজনই আক্রান্ত হন।

এ বিষয়ে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা বলেন, চোখের এই রোগ সংক্রামক হলেও বাতাসে ছড়ায় না। আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের সংস্পর্শে আসা কোনো জিনিস যেমন চোখে হাত দেওয়ার পর সেই হাত যেখানেই ছোঁয়ানো হয়, টাওয়েল, রুমাল ইত্যাদি অন্যের চোখের সংস্পর্শে এলে তার মধ্যেও ছড়ায়। তাই অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। নিজের ব্যবহার করা কাপড় কিংবা টাওয়েল আলাদা রাখতে হবে। যেখানে-সেখানে ব্যবহৃত টিস্যু ফেলা যাবে না। আর এই সময়ে বাসায় বিশ্রাম নিলে অন্য কেউ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। এটি ব্যাকটেরিয়াল কনজাংকটিভাইটিস বা ভাইরাল কনজাংকটিভাইটিস- দুটিই হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে ভাইরাল কনজাংকটিভাইটিসই বেশি হচ্ছে। ব্যাকটেরিয়ালটাও অনেকের ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে রোগী এসে আমাদের জানায় চোখ লাল হয়ে গেছে, চোখের পাতা ফুলে গেছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চোখ খচখচ করছে- এ ধরনের সমস্যার কথা।’

এই চিকিৎসক আরো বলেন, এ সময় যদি আমরা দেখি রোগীর চোখে আঠা আঠা হচ্ছে কিংবা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অনেক বেশি পিচুটি থাকছে তখন বুঝি এটি ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস। বর্তমানে যেটি দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে চোখের মধ্যে পানিজাতীয় জিনিস বেশি আসছে। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নেই যে এটি ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই এই সমস্যা নিয়ে আসছেন।

এ বিষয়ে সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এই সমস্যাকে কনজাংকটিভা বা চোখের প্রদাহ বলে। এটি নানা কারণে হতে পারে। যেমন- এলার্জি, বায়ুদূষণ, চোখে তীব্র আলো পড়া ইত্যাদি। এগুলো এ সমস্যার অসংক্রামক কারণ। তবে সম্প্রতি যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, এটি সম্ভবত কোনো সংক্রামক জীবাণুর মাধ্যমে ছড়াচ্ছে।’

এই রোগ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে জানিয়ে ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, কখনো কখনো এটি কর্ণিয়ায় ছড়ায়, এতে কর্ণিয়ার আলসার এমনকি অন্ধত্বের দিকে চলে যেতে পারে। একাধিক স্কুলে এ ধরনের ঘটনা দেখা দিলে স্বাস্থ্য বিভাগকে সতর্কতা জারি করতে হবে। প্রয়োজনে সেসব স্কুলে সাময়িক ছুটি দেওয়া যেতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close