বিনোদন প্রতিবেদক

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

‘পেয়ারার সুবাস’ পেলেন না আহমেদ রুবেল

দুই পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা আহমেদ রুবেল আর নেই। গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টা দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।

তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিচালক নুরুল আলম আতিক। তিনি বলেন, ‘আজ (বুধবার) সন্ধ্যায় আমার নতুন সিনেমা “পেয়ারার সুবাস”এর বিশেষ প্রদর্শনী ছিল। এতে অংশ নিতে আহমেদ রুবেল নিজেই গাড়ি চালিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে আসেন। পার্কিং থেকে হলে ঢোকার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

মঞ্চ, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের গুণী এই অভিনেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে রাখা হয়। এরপর বাদ আসর নিজ শহর গাজীপুরে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।’

একুশে টেলিভিশনের আলোচিত ধারাবাহিক নাটক ‘প্রেত’-এ অভিনয় করে দর্শকপ্রিয়তা পান আহমেদ রুবেল। আহীর আলম পরিচালিত প্রেত নাটকের গল্প লিখেছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তারপর থেকে নাটক ও সিনেমায় ব্যস্ততা বেড়েই চলে তার। একটা সময় নন্দিত লেখক, নাট্যকার ও পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় অভিনয় শুরু করেন। তার পরিচালিত শ্যামল ছায়া সিনেমায় অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল। এ ছাড়া অনেকগুলো ধারাবাহিক নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। সালাউদ্দিন লাভলুর সাড়া জাগানো নাটক ‘রঙের মানুষ’ ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর জনপ্রিয় নাটক ‘৬৯’-এ সাবলীল অভিনয় করে দর্শকনন্দিত হন।

তার অভিনীত ‘গেরিলা’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘আলফা’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমা প্রশংসিত হয়েছে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত ‘আলফা’ সিনেমাটি অস্কারে গিয়েছিল। গেরিলা সিনেমায় তিনি শহীদ আলতাফ মাহমুদের চরিত্রে অভিনয় করেন এবং সব বয়সি দর্শকের ভালোবাসা অর্জন করেন।

অভিনয় জীবন

নুরুল আলম আতিক পরিচালিত সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’ মুক্তির আগেই চলে গেলেন এ সিনেমার অভিনেতা আহমেদ রুবেল। গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বসুন্ধরায় স্টার সিনেপ্লেক্সে সিনেমাটির প্রিমিয়ার শোর অনুষ্ঠানে মারা যান এই গুণী অভিনেতা।

মঞ্চ, টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রের আলোচিত এই অভিনেতা ১৯৬৮ সালের ৩ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজারামপুর গ্রামে জন্ম নেন। আহমেদ রুবেল বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। অভিনয়ের সঙ্গে তার সখ্য মঞ্চ দিয়ে। প্রয়াত সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয় যাত্রা। তার প্রথম নাটক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নযাত্রা’। এরপর তিনি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ঈদনাটক ‘পোকা’য় অভিনয় করেন, যেখানে তার অভিনীত ‘গোরা মজিদ’ চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের ‘অতিথি’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘বিশেষ ঘোষণা’, ‘সবাই গেছে বনে’, ‘বৃক্ষমানব’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’ নাটকে রুবেলের অভিনয় প্রশংসিত হয়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ধারাবাহিক ‘প্রেত’ নাটকটি রুবেলকে দেয় অন্যরকম জনপ্রিয়তা।

এক পর্বের এবং ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে ‘বারোটা বাজার আগে’, ‘প্রতিদান’, ‘নবাব গুণ্ডা’, ‘এফএনএফ’, ‘একান্নবর্তী’, ‘রঙের মানুষ’, ‘পাথর’, ‘অতল’, ‘চেয়ার’, ‘স্বর্ণকলস’, ‘আয়েশার ইতিকথা’, ‘দূরের বাড়ি কাছের মানুষ’, ‘সৈয়দ বাড়ির বউ’সহ অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন রুবেল।

১৯৯৪ সালে বাণিজ্যিক ধারার ‘আখেরি হামলা’ সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্রে রুবেলের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ‘আজকের ফায়সালা’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘রঙিন রংবাজ’, ‘কে অপরাধী’, ‘সাবাস বাঙালি’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘পৌষ মাসের পিরিত’সহ ১৯টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তবে চলচ্চিত্রে রুবেলকে জনপ্রিয়তা ও পুরস্কার এনে দিয়েছে হুমায়ূনের ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘শ্যামল ছায়া’। এ ছাড়া ‘ব্যাচেলর’, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘গেরিলা’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘অলাতচক্র’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও রুবেলের মুক্তি পাওয়া সর্বশেষ সিনেমা ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ তাকে একজন দারুণ অভিনেতা হিসেবে বারবার তুলে ধরেছে।

কলকাতার সিনেমায়ও রুবেল কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে ভারতের নির্মাতা সঞ্জয় নাগ পরিচালিত ‘পারাপার’-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। হালের ওটিটিতেও রুবেল সরব হয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা’ হিসেবেও তাকে পাওয়া গেছে। ‘নয়ন রহস্য’ উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদ পরিচালিত ওয়েব সিনেমায় ‘ফেলুদা’ হয়েছিলেন রুবেল। এ ছাড়া ‘কাইজার’ সিরিজেও তাকে দেখা যায়।

শোবিজে শোকের ছায়া

গত বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লক্সে তার অভিনীত ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার বিশেষ প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন এই অভিনেতা। কিন্তু সিনেমার প্রদর্শনী শুরুর আগেই তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। অভিনেতার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শোবিজ অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমেছে।

নির্মাতা থেকে অভিনয়শিল্পী, কেউই রুবেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শোক জানিয়ে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী লিখেছেন, ‘বিশ্বাসই করতে পারছি না যে, অভিনেতা আহমেদ রুবেল ভাই আর নেই...।’ একই কথা বলেছেন অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান।

অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম লিখেছেন, ‘আহা! রুবেল ভাই! আপনার মতো এমন দারুণ একজন অভিনেতাকে কতটুকু সম্মান এই ইন্ডাস্ট্রি করতে পেরেছে জানি না। আপনার কাছ থেকে আর দুর্দান্ত অভিনয় দেখার সুযোগ হবে না! কিন্তু আপনার প্রতি রইল অফুরন্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। একজন আহমেদ রুবেল আর জন্মাবেন না, এই খেদ রইল মনে। যেখানেই থাকেন ভালো থাকেন।’

অভিনেতা জায়েদ খান লিখেছেন, ‘জীবন কত অনিশ্চিত। নন্দিত অভিনেতা আহমেদ রুবেল মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’

অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা লিখেছেন, ‘রুবেল ভাই, অভিনেতা বুঝিই এভাবেই চলে যায়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে। আপনাকে ভালোবাসি। কত কত স্মৃতি।’

নির্মাতা সঞ্জয় সমাদ্দার লিখেছেন, ‘আজকে তার অভিনীত সিনেমা পেয়ার সুবাস-এর প্রিমিয়ার শো। যাচ্ছিলেন হলের দিকে! নির্মাতার সঙ্গে লিফটে অচেতন হয়ে পড়লেন। চিরকালের জন্য! আহমেদ রুবেল ভাই চলে গেলেন! এমন কণ্ঠের এমন অসাধারণ অভিনেতাকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। পঞ্চান্ন খুব অল্প সময়, এমন অসাধারণ প্রতিভার জন্য। শোক ও শ্রদ্ধা ভাই।’

সহশিল্পীর মৃত্যুর খবরে যা বললেন জয়া

গত বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লক্সে তার অভিনীত ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার বিশেষ প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন এই অভিনেতা। কিন্তু সিনেমার প্রদর্শনী শুরুর আগেই তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমায় জয়া আহসানের বিপরীতে অভিনয় করেছেন রুবেল।

প্রিমিয়ার শোতে একই সঙ্গে সিনেমা দেখার কথা ছিল অভিনেত্রীর। কিন্তু অভিনেত্রী উপস্থিত হতে পারলেও না-ফেরার দেশে চলে গেছেন অভিনেতা। তার এই মৃত্যু বিশ্বাস করতে পারছেন না জানিয়ে জয়া বলেন, ‘এটা খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না রুবেল ভাই নেই। আমার মনে হয় রুবেল ভাই থাকলে নিশ্চয়ই চাইতেন না আমাদের শো বাতিল হোক। মানুষ তার কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে। রুবেল ভাইও আমাদের মধ্যে আছেন। শো চলবে। এটা আমাদের শিল্পীদের জীবনের একটি ভয়াবহ অংশ।’

সে সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবার মৃত্যুর দিনের কথা স্মরণ করে অভিনেত্রী বলেন, ‘আমার বাবার যেদিন মৃত্যু হলো সেদিন আমি কলকাতায় ছিলাম। আমার প্রথম বাংলা সিনেমার শুটিংয়ে অংশ নিতে। শুটিং করছিলাম, তখন বাবার মৃত্যুর খবর পাই। শেষ দিকের শুটিং, মাত্র দুটি দৃশ্য ধারণ বাকি ছিল। আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম আর পরিচালককে জিজ্ঞেস করছিলাম আমি কী করব? আমি কি শুটিংটা শেষ করে যাব? আমাদের শিল্পীদের জীবনটাই এমন।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close