আজিজ ওয়েসি, চবি

  ২৩ মে, ২০২৪

অন্যরকম এক ম্যারাথন দৌড়ের অনুভূতি

পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দের কোনো সীমা নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয় একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে। দিনের আলোতে তার যেমন এক অনন্য সৌন্দর্য রয়েছে, তেমনই রাতের আঁধারেও রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এমন অনন্য রূপ দান করেছে তার প্রকৃতি। ছোট-বড় পাহাড়, গাছপালা, লতাপাতা, ফুল-ফল ইত্যাদি প্রকৃতির নিজস্ব দান। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন কোনো ম্যারাথন দৌড় আয়োজন করা হয়, তখন প্রকৃতি যেন প্রেমরসে সিক্ত হয়। এমনিভাবে প্রকৃতিকে প্রেমে মাতিয়ে তুলেছিল ‘রান বাংলাদেশ’ সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত ২৫ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড়।

সেদিন ভোরের আলো ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিল। ম্যারাথন দৌড় সাধারণত শীতের ভোরেই হয়ে থাকে। প্রচন্ড শীতে ভোরবেলা যখন বিছানা ছাড়তে মনে চায় না, ঠিক এমনই একটি মুহূর্তে ‘রান বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত হয়েছিল ম্যারাথন দৌড়টি। এত শীতের মধ্যে মানুষ কীভাবে বিছানা ছেড়ে চলে আসে তা ম্যারাথনে না গেলে বোঝা যায় না। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো ম্যারাথন দৌড়ে যেমন সুস্থ থাকা যায়, তেমনই এর মাঝে রয়েছে অনেক আনন্দ উপভোগ। তাই তো শীতের প্রচন্ড কুয়াশার ভোরেও দৌড়বিদরা চলে আসেন ম্যারাথন দৌড়াতে। আর পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যারাথনে ছিল আরো অনেক বেশি আনন্দ উপভোগ।

ম্যারাথন ইভেন্টের রাতে আমি আবেগে উৎফুল্ল হয়ে থাকি। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারি না। এ রকম পরীক্ষার আগের রাতেও আমার ঘুম হয় না। যাই হোক, কখন দৌড় শুরু হবে এই ভাবনায় আমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। যখন রাত তিনটা বাজে তখন থেকে আমি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। আমাদের দৌড় শুরু হবে ভোর ৬টায়। তাই আমি তিন ঘণ্টা আগে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। কারণ ২৫ কিলোমিটার বা হাফ ম্যারাথন দৌড় সুস্থভাবে সম্পন্ন করতে হলে তিন ঘণ্টা আগে থেকেই শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়। কারণ খাবার ও হাইড্রেশনের বিষয়ে সময়মতো প্রস্তুতি নিতে না পারলে সুস্থভাবে ইভেন্ট সম্পন্ন করা যায় না। এজন্য আমি ঠিক সময়ে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম। শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমি ম্যারাথন দৌড়ের জুতা পরে চলে এলাম স্টারটিং পয়েন্টে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ও শেখ কামাল জিমনেসিয়ামের পাশে ছিল আমাদের স্টারটিং পয়েন্ট।

স্টারটিং পয়েন্টে এসে ভেতরে অসাধারণ এক অনুভূতি তৈরি হলো। কারণ এখানে এসে দেশের বিভিন্ন জেলার ম্যারাথন দৌড়বিদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ সারা দেশ থেকে অনেক দৌড়বিদ এসেছিল। বিভিন্ন জায়গায় ম্যারাথন দৌড়াতে গিয়ে তাদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমরা সবাই ভোর সাড়ে ৫টায় স্টারটিং পয়েন্টে এসেছিলাম। ম্যারাথন দৌড় শুরু করার আগে শরীর গরম করে নিতে হয়। এজন্য আমরা সবাই একসঙ্গে চবির কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ওয়ার্মআপ বা শরীর গরম করার এক্সারসাইজ করে নিলাম। ইতিমধ্যে হ্যান্ড মাইকে ডাক এলো, যারা বিব নম্বরে মার্ক করেননি, দ্রুত মার্ক করে নিন। বিব নম্বর হলো একেকজন দৌড়বিদের একেকটা পরিচয় নম্বর, যা বুকের মধ্যে পিন মেরে লাগিয়ে দৌড়াতে হয়। যাই হোক, তখন আমাদের দৌড় শুরু হওয়ার আরো পাঁচ মিনিট বাকি। আমরা বিব নম্বরে মার্ক করে স্টারটিং পয়েন্টে দাঁড়ালাম। স্টারটিং পয়েন্টে দাঁড়ালে আমার বুক ধড়ফড় করে। এই একটি ইতস্তত বোধ আমার শৈশব থেকে। যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ক্যাটাগরির দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজন হতো, তখন থেকেই স্টারটিং পয়েন্টে দাঁড়ালে আমার বুক ধড়ফড় করত। এখন সেই ধুকধুকানি বুকের মধ্যে রয়েই গেছে। যতটুকু জানতে পারলাম, যারা খেলাধুলায় ভালো প্রতিযোগী তাদের এই ধুকধুকানি বেশি থাকে। ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় আমার এমন একটা ধড়ফড়ানি ও হৃৎস্পন্দন আমাকে অনেক সাহসী করে তোলে। কারণ পুরো ২৫ কিলোমিটার দৌড় কীভাবে সম্পন্ন করব, কীভাবে ভালো পজিশন, ভালো টাইমিং করব তার একটা পরিকল্পনা মনের মধ্যে সেট করে নেই।

যাই হোক, এমন আবেগে উৎফুল্ল ও উত্তেজিত মুহূর্তে আমাদের পাশে শানাই বাজছিল। শানাইয়ের বাজনার তালে তালেই আমার হৃৎস্পন্দন হচ্ছিল। আর ঠিক এমন মুহূর্তে অন ইউর মার্ক বলেই বাঁশিতে ফুঁতকার দিলেন কোনো একজন। শুরু হলো ২৫ কিলোমিটার দৌড় প্রতিযোগিতা। বাজতে থাকল শানাই। বাজনার তালে তালে দৌড়বিদরা নাচের ভঙ্গিতে দৌড় শুরু করল। স্টারটিং পয়েন্ট থেকে প্রায় ১০০ মিটার জায়গা উঁচু ঢালু ছিল। আমি সেখানে পরিকল্পনামাফিক একটা দৌড় শুরু করলাম। আমার শরীরের মধ্যম গতি প্রয়োগ করলাম। কারণ, ম্যারাথন দৌড়ের শুরুটা সাধারণত স্বাভাবিক স্পিডে শুরু করতে হলেও সেখানে উঁচু ঢালু জায়গা ছিল। আর এজন্যই আমার স্টারটিংটা ভালো হয়েছিল। অনেকে সেখানে স্পিডে বা খুব দ্রুত শুরু করেছিল। এর ফলে ৫০ মিটার পরই এরা হাঁপিয়ে পড়েছিল। যাই হোক, আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী দৌড়াতে থাকলাম। আমি পুরোপুরি মনোযোগ সহকারে দৌড়াতে থাকলাম। কারণ ২৫ কিলোমিটার দৌড় আমাকে সুস্থভাবে সম্পন্ন করতে হবে। ভুলভাবে দৌড়ালে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দৌড়টি শুরু হওয়ার পর প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তর হয়ে সোহরাওয়ার্দী মোড়ে গেল। সেখান থেকে ইউটার্ন নিয়ে আবার নিরাপত্তা দপ্তর হয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের দিকে চলল। আমি তখন প্রয়োজনমতো গতি প্রয়োগ করলাম। কারণ এখন আমাকে আমার নিয়মিত গতিতে দৌড়াতে হবে। এখন সমান রাস্তা। কোনো ধরনের উঁচুনিচু নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা চলে এলাম শহীদ মিনার ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরের পাশে। তখন আমার সঙ্গে ছিল চবি আলাওল হলের সুজন ভাই। সিলেটের শাহীন আলম এবং নরসিংদীর একজন অপরিচিত ম্যারাথন দৌড়বিদ। তখনো আমরা চারজনে সমান তালে দৌড়াচ্ছি। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টির পাশে। এখানে এসে একটা ওয়াটার পয়েন্ট পেলাম। ওয়াটার পয়েন্ট হলো ম্যারাথন দৌড়বিদদের জন্য কয়েক কিলোমিটার পরপর পানি রাখার সুব্যবস্থা। স্টারটিং পয়েন্ট থেকে এই জায়গার দূরত্ব ছিল তিন কিলোমিটার। এজন্য আমি এখানে পানি পান করিনি। আমার সঙ্গে অন্য কেউই করেনি। কারণ ৭-৮ কিলোমিটার পর থেকে পানি পান করলে ভালো। এত তাড়াতাড়ি পানি পান করলে দৌড়ের গতির মধ্যে হেরফের তৈরি হয়। সবচেয়ে উপভোগের জায়গা ছিল বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টি ছাড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে।

বায়োলজিক্যাল ফ্যাকাল্টির পর আমাদের পাকা রাস্তার সমাপ্তি ঘটে এবং আমরা পাহাড়ের ভেতর প্রবেশ করি। পাহাড়ের উঁচুনিচু রাস্তায় এটাই আমার প্রথম ম্যারাথন ছিল। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে দৌড়ানোর আনন্দটাই আলাদা। ভোরবেলা সবাই যখন শীতের কুয়াশায় ঘুমে নিমজ্জিত তখন আমরা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দৌড়াই। তাদের সঙ্গে আমাদের কত পার্থক্য। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সকালে ঘুমালে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। এ জন্য তারা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে হাঁটাহাঁটি ও দৌড়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর আমরাও দৌড়াই। যে কারণে সুস্থ থাকি। ফলে অন্যদের থেকে আমরা বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হই।

যাই হোক, আমরা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে তিন কিলোমিটার দৌড়ালাম। তারপর চবি বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে হতাশার মোড়, সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন ফটক জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত আসি। এখানে একটা মেডিকেল টিম দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়াতে এসে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে এই মেডিকেল টিম প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগল।

জিরো পয়েন্ট থেকে আরো দুই কিলোমিটার সামনে আমাদের স্টারটিং পয়েন্ট। সেখানে যাওয়ার জন্য আমরা চবির ২ নম্বর গেট হয়ে জোবড়া গ্রামে প্রবেশ করি। তারপর জোবড়া গ্রামের হিন্দু মন্দির পাড়ি দিয়ে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। সেখান থেকে আবারও স্টারটিং পয়েন্ট। স্টারটিং পয়েন্ট আসার পর আমাদের ৮ কিলোমিটারের কিছু বেশি জায়গার দৌড় সম্পন্ন হলো।

এই ৮ কিলোমিটার জায়গা দৌড়াতে গিয়ে আমরা পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে এসেছি। ঘুরে দেখেছি। এক হলো ম্যারাথন অনুভূতি এমনেই অনেক আনন্দদায়ক হয়। তার মাঝে চবি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার আনন্দ আমাদের আরো প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল করে তোলেছিল। যাই হোক, আমাদের দৌড় এখনো শেষ হয়নি। কারণ আমাদের ২৫ কিলোমিটার দৌড়াতে হবে। এজন্য পুরো ক্যাম্পাসটি আমাদের তিন চক্কর দিতে হবে।

সবচেয়ে উদ্ভূত বিষয় হলো, ৮ কিলোমিটার পর আমার পায়ে জুতার আঘাতে ব্যথা শুরু হয়েছিল। যার ফলে আমার স্বাভাবিক গতি কমে যায়। তাই চারজনের মধ্যে দুজন রানার বা দৌড়বিদ আমাদের সামনে চলে যায়। আমি আর সুজন ভাই একসঙ্গে রইলাম। মজার বিষয় হলো, যখন ১০ কিলোমিটার দৌড় শেষ হলো, আমি গতি বাড়াই। ফলে সুজন ভাই আমার পেছনে পড়ে যায়। এরপর বাকি ১৫ কিলোমিটার দৌড় আমি একা একা দৌড়াই। একটা সময় আমার আগে-পিছে কাউকেই দেখতে পাইনি। কারণ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটু দূরে গেলেই কাউকে দেখা যায় না। সবশেষে আমি সুস্থভাবে এই ২৫ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করি এবং ৪ নম্বর অবস্থান অর্জন করি। সুস্থ থাকার জন্য আমি ম্যারাথন দৌড়ালেও, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এমন অসাধারণ ম্যারাথন আনন্দ উপভোগ আমাকে প্রাণবন্ত করে তোলেছিল। স্মৃতির পাতায় থাকল আমার সেই অনন্য ম্যারাথন দৌড়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close