মোস্তাকিম সাদিক, নোবিপ্রবি

  ০৮ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়স্মারক ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’

জয় বাংলা। বাঙালির পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি। স্লোগানটি যেমন শক্তি জুগিয়েছিল লড়াকু মুক্তিকামী বাঙালিদের, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের ইতিহাসকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুলে ধরতে ‘জয় বাংলা’ নামে স্থাপন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য।

উপকূলীয় অক্সফোর্ডখ্যাত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখা মিলবে ভাস্কর্যটির। ভাস্কর্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ন’মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা। বাঙালির বীরত্বগাথা সংগ্রামকে স্মৃতিতে ধারণ করে আছে ভাস্কর্যটি। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের ইতিহাসকে তুলে ধরার প্রয়াসে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর এ কে এম সাঈদুল হক চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’ উদ্বোধন করেন। শিল্পী দুলাল চন্দ্র গাইনের নকশার ভিত্তিতে স্থাপিত হয় এই অপরূপ শিল্পকর্মটি।

একটি দেশের ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো ভাস্কর্য। যেটি নিছক কোনো মাটির তৈরি বস্তু নয়, বরং এটি বহন করে সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। ভাস্কর্যটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধজয়ের একটি মুহূর্তকে তুলে ধরা হয়েছে। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধজয়ের পর বিজয় উল্লাস করছে। তাদের পেছনে উড়ছে বিজয় নিশান। ভাস্কর্যে ব্যবহৃত তিনজন যোদ্ধার মধ্যে মাঝের যোদ্ধাকে অপেক্ষাকৃত বড় করে দেখানো হয়েছে। লুঙ্গি পরা খালি গায়ের এই যোদ্ধাকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরাই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। এই যোদ্ধার ডান পাশে শার্ট-প্যান্ট পরা ও হাতে রাইফেল ধরা এক যুবক যোদ্ধাকে ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্যপাশে অবস্থিত নারী যোদ্ধার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে বোঝানো হয়েছে। তিনটি স্তরের ওপর ভাস্কর্যটি স্থাপিত। যেখানে প্রতিটি স্তরের রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। প্রথম স্তরের তাৎপর্য হলো ভাষা আন্দোলন, দ্বিতীয় স্তরের তাৎপর্য হলো স্বাধীকার আন্দোলন এবং তৃতীয় স্তর তথা মূল বেদী হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি খন্ডচিত্র মূল বেদীর চারদিকে টেরাকোটার মাধ্যমে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। বেদীর সামনের দিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। বেদীর দ্বিতীয় দিকে ২৫ মার্চের গণহত্যা, তৃতীয় দিকে মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য এবং বেদীর চতুর্থ দিকে পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণের দৃশ্য টেরাকোটার মাধ্যমে উৎকীর্ণ করা হয়েছে।

বেদীসহ ভাস্কর্যের শীর্ষদেশ পর্যন্ত (নিচের সর্বনিম্ন স্তর থেকে পতাকার শীর্ষ) দৈর্ঘ্য স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে সংগতি রেখে ২৬ ফুট করা হয়েছে। এর মধ্যে বেদীর উচ্চতা ১১ ফুট এবং মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা (বেদীর ওপর থেকে) ১৫ ফুট। ভাস্কর্যের জন্য সাদা ও গ্রে সিমেন্টের সংমিশ্রণ ও মোজাইক চিপস এবং টেরাকোটার জন্য পোড়ামাটি ব্যবহার করা হয়। পুরো ভাস্কর্যটি নির্মাণ হতে সময় লেগেছে ৪ মাস ১৫ দিন এবং ব্যয় হয়েছে ৪৬ লাখ ২২ হাজার ২৬৫ টাকা।

আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করা এই ভাস্কর্য প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য যে দেশপ্রেম এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে দেখিয়েছে তার বাস্তব দৃশ্যই ফুটে ওঠে জয় বাংলা ভাস্কর্যে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষার্থীদের। নোবিপ্রবির শিক্ষার্থী ছাড়াও অসংখ্য ভ্রমণপিপাসুকে আকৃষ্ট করে এই ভাস্কর্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের নানা প্রান্ত থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে শিক্ষা সফরে নিয়ে আসে। ভাস্কর্যকে ঘিরে চারপাশের ফুলের বাগান এই সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close