আহসান হাবীব রানা, ইবি

  ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩

দুই চাকায় প্রাতর্ভ্রমণ

সাইকেল চালাতে সবাই ভালোবাসে। এটি শুধু যাত্রাপথের সময়ই বাঁচায় না, মন রাখে প্রফুল্ল, শরীর রাখে সুস্থ। দলবদ্ধ রাইডিংয়ে তৈরি হয় একটি কমিউনিটি। এ ছাড়া সাইকেল চালানো একটি উৎকৃষ্ট অ্যারোবিক ব্যায়াম। ওজন নিয়ন্ত্রণ, হৃদযন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে, বাতজনিত ব্যথা নিয়ন্ত্রণে এই ব্যায়ামের কোনোই জুড়ি নেই। নিয়মিত শারীরিক কসরত ও ঘোরাফেরার অংশ হিসেবে আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে কিছুদিন আগে সাইকেলে প্রাতর্ভ্রমণে বের হয়ে এবং ক্যাম্পাস থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের গলাকাটা তালগাছের সড়ক ঘুরে আসি।

রাতে দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস কাটাতে ও সকালের শিশিরভেজা প্রকৃতি উপভোগ করে আমরা কয়েকজন মিলে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হই। আমি, রাহাত, ইবনে সিনা, মাহমুদ, শাহরিয়ার এবং জাহিদ মিলে আমরা প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটতে বের হই। প্রত্যহ হাঁটতে বের হওয়ার সময় আমরা প্রতিনিয়ত নতুন রাস্তা খুঁজি আর নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করি। এভাবে কয়েক দিন হাঁটার পর ক্যাম্পাস ও আশপাশের রাস্তাগুলো আমাদের প্রায় ঘোরা শেষ। এরপর এক দিন আমরা সবাই মিলে প্ল্যান করলাম দূরে কোথাও সাইকেল ভ্রমণে বের হব।

যেই ভাবা সেই কাজ। সবাই মিলে পরিকল্পনা করলাম পরের দিন সোমবার, ক্যাম্পাসে অনলাইন ক্লাস চলে, সেদিনই আমরা বের হব। সেদিন কখন বের হব, কীভাবে সাইকেল ম্যানেজ করব এসব প্ল্যান শেষ করে যে যার যার মতো রুমে গেলাম।

পরেরদিন ঠিক ভোর ছয়টা পনেরো। আশ্বিনের শেষের সকাল। চারপাশে কুয়াশার তীব্রতা চোখে পড়ছে। ক্যাম্পাসের চারদিকে ছেয়ে আছে কুয়াশায়। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে রাহাত সবাইকে হল থেকে বের করে জিয়া মোড়ে একত্র করল। এরপর ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক থেকে মহাসড়ক হয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। আজ সকালের পাখিদের সঙ্গী হতে আমরাও উড়তে বেরিয়েছিলাম। তবে ডানা নয়, দুই চাকার সাইকেলে। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক, সকালের নীরবতা, শীতল হাওয়া- এসবের মধ্যেই আমাদের দুই পায়ে প্যাডেল চলছে সমান তালে।

গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে যতদূর আগাচ্ছি ততই সকালের স্নিগ্ধতা, শীতলতা আমাদের গা ছুঁয়েছে। সবার মন বেশ ফুরফুরে। কুয়াশার টানে শিশির মোড়ানো দূর্বা পেরিয়ে দূর দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া সেকি দারুণ অনুভূতি। যত পথ যাচ্ছি দূরের আকাশে সূর্যের বিচ্ছুরিত আলোয় কুয়াশায় ডেকে যাওয়া রাস্তার দুধারের গাছপালা- বসতবাড়িগুলো স্পষ্ট হচ্ছিল। এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, বিরতি প্রয়োজন আর ক্ষিধেও লেগেছিল। সামনে বাজার পেলে নাশতা এবং বিশ্রাম সেরে নেব এই ভেবে সামনে এগোতে লাগলাম। এরপর কিছুদূর যাওয়ার পর সামনে একটা বেশ বড় বাজার পেলাম। সেখানেই বিশ্রাম ও সকালের নাশতা সেরে নিলাম।

বিরতি শেষে আবার বেরিয়ে পড়লাম নতুন উদ্যমে। বাজার পেরিয়ে গ্রামের পথ ধরে আরো ৭/৮ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার পর একটা স্থানে এসে আমরা থেমে গেলাম। রাস্তার দুপাশে সারি সারি তালগাছ, আশপাশে তেমন কোনো জনপদ নেই। বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেতের মধ্য দিয়ে পাকা সড়ক। সড়কটির নাম তালগাছের সড়ক। কাঁচা ধানের মাঠ পেরিয়ে পাকা সড়ক কতদূর গেছে জানি না, তবে আমরা সারি সারি তালগাছে বেষ্টিত সড়কের সৌন্দর্যে আটকে গেছি।

বারবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যকের ঘন অরণ্য’-এর কথা মনে পড়ছিল। মানসপটে অরণ্য, নিস্তব্ধতা, গাছের সারি কিংবা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। সাইকেল থামিয়ে চুপচাপ কান পেতে আছি আমরা। শালিকের ডাক কানে তীব্রভাবে লাগছে। ঘুঘুর ডাক খুব শান্ত, কিছুটা ব্যাকুল করছে প্রাণ। প্রকৃতির সঙ্গে নিজের যোগাযোগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা! তাকিয়ে আছি লম্বা গাছগুলোর দিকে, আর ভাবছি কত উদার প্রকৃতি, কি সুন্দর ছায়া দিয়ে যাচ্ছে পথচারীদের। এরপর এই ছোট্ট ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে সবাই মিলে কয়েকটি স্থিরচিত্র ধারণ করে নিলাম।

বেলা অনেক দূর গড়িয়েছে, এবার ফেরার ফালা। ক্লান্ত শরীরে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে ফিরে আসছি। তবে এতটা পথ সাইকেলের প্যাডেল চাপতে যতটা কষ্টের মনে হচ্ছিল সেটা আমাদের জন্য ততটাই উপভোগ্য। তবে কিছুদূর যেতেই আমরা এক বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, একটা সাইকেলের প্যাডেল ভেঙে যায় এবং চেইন ছিঁড়ে যায়। সাময়িক দুশ্চিন্তা হলেও মনোবল না হারিয়ে আমরা ভাঙা সাইকেল নিয়েই সামনে এগিয়ে যাই এবং কিছুদূর যেতেই একটা ম্যাকানিকের দোকান দেখতে পাই। সেখানেই সাইকেল সারিয়ে নিয়ে আমার ফেরার যাত্রা পুনরায় শুরু। অবশেষে দুপুর ১২টায় ছয় ঘণ্টার ছোট্ট ভ্রমণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছাই। দুই চাকার সাইকেলে প্যাডেল চেপে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অঙ্কিত থাকবে জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর তালিকায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close