প্রত্যেক নারীর মধ্যেই রোকেয়ার প্রতিচ্ছবি
নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম আজকের সমাজের নারীদের জন্য অনন্য উচ্চতা। প্রত্যেক নারীর মধ্যে বেগম রোকেয়ার প্রতিচ্ছবি বিদ্যমান। যারা এখনো সাহসী সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। বর্তমানে কতটা সহজ হয়েছে নারীর জীবন একজন রোকেয়া ছিল বলে। রোকেয়া দিবসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ভাবনাগুলো একত্রে তুলে ধরেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদা টুম্পা
সমাজ বিনির্মাণের কারিগর বেগম রোকেয়া
অবরোধবাসিনীদের মুক্তির জন্য যে নারী জন্ম থেকে লড়াই করেছেন তিনি বেগম রোকেয়া। পরিবার যথেষ্ট অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয়ের পাঠ তার ভাগ্যে জোটেনি। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও নারীদের বিদ্যালয়ে পড়ার উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। নারীরা স্বাভাবিকভাবে তাদের শালীনতা রক্ষা করে শিক্ষা গ্রহণ করবে, সমাজে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করবে, সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করবে এই সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবে- এমনটাই ছিল বেগম রোকেয়ার চাওয়া। গৃহে বন্দি থেকে নয় বরং পুরুষের সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রখর আন্তরিকতা ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের কথাই বলেছেন তার বক্তৃতা, চিঠি এবং রচনায়। এক সর্বমানবিক উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেগম রোকেয়া সমাজে জেঁকে বসা কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শুধু নারীদের উন্নয়নে নয় বরং তার অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে তার রুচি ও মনুষ্যত্ববোধের স্তরকে ধর্মণ্ডবর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য অবারিত করে তুলেছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এ সমাজে নারী-পুরুষ উভয়কেই হতে হবে সমান সক্রিয় তাহলেই সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। বেগম রোকেয়া দিবসে এই মহীয়সীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
মাকসুদা আক্তার
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রোকেয়া দিবস ও আজকের নারীর জাগরণ
নারী জাগরণের ক্ষেত্রে যেসব মহীয়সী নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে বেগম রোকেয়ার নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৮০ সালে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই নারী পরে নারীদের শিক্ষা, স্বাধীনতা, বৈষম্য মুক্তি, অন্ধকারের বেড়াজাল থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। ৯ ডিসেম্বর প্রতিবছর রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের মূলত অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হলো নারীদের এই বৈষম্য মুক্তির সংগ্রাম দীর্ঘদিনের, শিক্ষার আলো মূলত নারীরা বেগম রোকেয়ার হাত ধরেই দেখেছিলেন। তার এই সংগ্রামকে সমোজ্জ্বলিত রাখতে এই দিবসটিকে স্মরণ করা হয়। উল্লেখযোগ্য অবদান হলো সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল এরপর বঙ্গদেশের মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষা, স্বাবলম্বন এবং বিজ্ঞানমনস্কতার আলো ছড়িয়ে দিতে স্থাপন করেন ‘আঞ্জুমন-ই-খাওয়াতীনে ইসলাম’। স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার এবং নারীর অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে অবিচল থেকে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরোধিতায় বেগম রোকেয়া তার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমান সময়ে মুসলিম নারীসমাজের শিক্ষা-দীক্ষার যে প্রসার লক্ষ করা যায় তাতে মনে হয় রোকেয়ার আশা বোধহয় পূর্ণ হয়েছে। এই নারী শিক্ষাকে আরো বেশি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘরে ঘরে রোকেয়ার মতো নারী জাগরণের অগ্রদূত জন্মানো প্রয়োজন।
ফারিয়া ইয়াসমিন
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন হবে কবে
একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। অংশ নিচ্ছে নানা গৌরবান্বিত ইতিহাসের। আজ শুধু ঘর নয়, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে পুরো দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে নারীরা। এগিয়ে চলছে পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে। এসব কিছুতে রোকেয়ার অবদান বিদ্যমান। তবু এখনো অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। পারিবারিক, সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে নিজের মেধা-মনন, যোগ্যতায় সাফল্যের দেখা পাচ্ছে যেসব নারী তাদের আবার শুনতে হচ্ছে নারী বলেই সহজ হয়েছে তার সাফল্য অর্জন। সেটা শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু হয়ে চলতে থাকে কর্মজীবনেও। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে পরিস্থিতিটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি জরুরি ছিল এ দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন ঠিক রোকেয়ার মতো করে। নারীকে নারী হিসেবে নয় চিন্তা করা দরকার ছিল মানুষ হিসেবে। আর তা বাস্তবায়ন হলে নারী নির্যাতন বন্ধে, নারী অধিকার রক্ষায় কোনো আন্দোলন বা নির্দিষ্ট দিবসের প্রয়োজন হতো না। আমরা কবি নজরুলের সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারতাম, এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল-নারী দিল তাহে রূপ-রস-সুধা-গন্ধ সুনির্মল।
ইসরাত জাহান চৈতী
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নারীর অগ্রযাত্রা এবং বেগম রোকেয়া
প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর জাতীয়ভাবে পালিত হয় বেগম রোকেয়া দিবস। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। আজ নারী হয়েও যে ফিচারে মতামত লেখার সুযোগ পাচ্ছি, সেই কলম চালানোর রাস্তা সুপ্রসারিত করেছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারী ছাড়া যে সমাজ অচল, সেই চিরন্তন সত্যটা নানা উপমার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের এই মহীয়সী নারী। তারই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ নারীর বিচরণ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। যে নারীরা একসময় ঘরের বাইরে বের হতেই বাধাপ্রাপ্ত হতো, আজ তারা আকাশপথও নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবেই জয়ী হতে থাকুক নারীর তরবারি।
মোনালিসা মুজিব মিম
ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বেগম রোকেয়ার লালিত স্বপ্ন পূরণ হোক
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সংস্পর্শে এসে উপমহাদেশের নারীসমাজ লাভ করেছে মুক্তির দিশা। অবহেলিত নারী সমাজকে তিনি দিয়েছিলেন এক অভাবনীয় আলোকবতির্কার সন্ধান। নারী জাগরণের জন্য এবং সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য তিনি একদিকে কলম হাতে তুলে নেন। অন্যদিকে নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন স্কুল। তখনকার সময়ে দাঁড়িয়েও তার সেই দুঃসাহসিক অভিযান অনেকটাই সফল হয়েছে। তার উত্তর প্রজন্মের নারীরা তার অনুপ্রেরণার হাত ধরে এগিয়ে এসেছে। ক্রমেই সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সমাজে নারীরা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে নারীর অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে। নারীদের এই অদম্য অগ্রযাত্রা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবু কোথাও যেন একটু বাধা রয়েই গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও নারীরা আজও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিও লক্ষণীয়। এ দেশে এখনো নারীরা একা পথ চলতে ভয় পায়। তা ছাড়া উচ্চশিক্ষা অর্জনেও বাধা রয়ে গেছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীরা। রোকেয়া দিবসের প্রত্যাশা সব বাধা ও সংকট মোকাবিলা করে নারীরা এগিয়ে যাক অদম্য গতিতে। বেগম রোকেয়ার লালিত সেই স্বপ্ন পূরণ হোক।
রুখসানা খাতুন
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
নারী মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া ছিলেন নারী মুক্তির পথপ্রদর্শক। তার জন্যই আমরা নারীরা আজ সমাজ ও পরিবারের অন্তঃপুরের গন্ডি পেরিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি নিজেদেরও বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছি। নিজেকে শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও আত্মমর্যাদাশীল করে গড়ে তোলার সাহস পেয়েছি। বেগম রোকেয়া বাঙালি নারীদের কাছে গল্পের সেই সোনার কাঠিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। নারীদের নিয়ে দেখা তার স্বপ্ন আজ বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। তার জন্যই নারীরা চার দেয়ালের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাইরের খোলা হাওয়ায় ইচ্ছেমতো পাখা মেলতে পারছে। তার জন্যই আজ আমরা নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিতে শিখেছি এবং নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে পারছি। তার এই অবদান কখনোই ভোলার নয়। যুগ যুগ ধরে তিনি থেকে যাবেন আমাদের মনের মনিকোঠায় চির অম্লান হয়ে?
জান্নাতুল বৃষ্টি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
"