মোহাম্মদ রাজীব মিয়া, কুবি

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

থিয়েটার কুবির নাট্যোৎসব মঞ্চায়ন হলো ৬ নাটক

নাটক বা ড্রামা হলো আধুনিক ও গতিশীল শিল্প উপকরণ। তার অন্যতম কারণ নাটকে থাকে জীবনের অনুলিপি। জীবনসায়াহ্নে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় নাটকের কাহিনি সমগ্র। সামাজিক অনাচার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও কুসংস্কার নিয়ে তৈরি নাটক আমাদের সমাজকে সব সময়ই নাড়া দিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে সমাজমননে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে নাটক। নাটকের মাধ্যমেই সমাজের সমসাময়িক কিংবা ঐতিহাসিক প্রতিটি ঘটনার বার্তা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছরের মতো এ বছরও থিয়েটার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছে তৃতীয় আন্তবিভাগ নাট্য প্রতিযোগিতা উৎসব। এ নাট্যোৎসবের ফাইনালে অংশগ্রহণ করেছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, গনিত বিভাগ, বাংলা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের নাট্য কলাকুশলীরা।

বুধবার (১৫ নভেম্বর) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তরুণ নাট্যশিল্পীরা মঞ্চায়ন করেন নাটকগুলো। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নাট্যশিল্পীরা ‘আর্তনাদ’, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের নাট্যশিল্পীরা ‘পাগল পাগল বদ্ধ পাগল’, গণিত বিভাগের নাট্যশিল্পীরা ‘সাল ১৯০৮’, বাংলা বিভাগের নাট্যশিল্পীরা ‘চণ্ডালিনী’, ইংরেজি বিভাগের নাট্য শিল্পীরা ‘একটি আষাঢ়ে গল্প’ এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের নাট্যশিল্পীরা ‘নিমিত্ত’ নাটক মঞ্চস্থ করেন।

যে নাটকে দুলি পাগলির ‘মাতৃত্ব’ জেগে ওঠে

রাজধানীর কল্যাণপুরের ফুটওভারব্রিজের বেশ কজন নিম্নশ্রেণির মানুষের রাত্রিকালীন ঘটনা নিয়ে ‘চণ্ডালিনী’ নাটকের প্রারম্ভ। সে রাতের কিছু খণ্ডচিত্র দিয়ে নাটকটি ধীরে ধীরে ক্লাইমেক্সের দিকে ধাবিত হয়। প্রথমে নাটকের এক ভাসমান পতিতা ফতির তিন পুত্রের (শিশুপুত্রসহ) সঙ্গে নাটকের প্রধান চরিত্র এক বিকৃত আধ পাগলিনীর বাকবিতণ্ডা। এদিকে নাটকের প্রধান চরিত্র দুলির প্রতি দুই ভিক্ষুক নজু ও কালুর বিরক্তি। অন্যদিকে ব্রিজের ওপর সস্তায় খোদেজা পতিতার সন্ধানে চাক্কু মজিদ নামে এক মাতালের অনুপ্রবেশ। খোদেজা এইডস আক্রান্ত তা বিষয় নিয়ে চাক্কু মজিদ ও নজু-কালুর হালকা রসালাপের সঙ্গে তিনজনের নেশাগ্রহণ। এবার ‘জলে ভাষা পদ্ম আমি, শুধু পেলাম ছলনা’ গাইতে গাইতে মঞ্চে প্রবেশ করেন খোদেজা। খোদেজা চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে মঞ্চে প্রবেশ করলেও তার মূল উদ্দেশ্য ছিল খদ্দর চাক্কু মজিদকে শারীরিকভাবে প্রলুব্ধ করা। এরপর চাক্কু মজিদের মদ খেয়ে বেশামাল খোদেজার অসুস্থ হয়ে যাওয়া এবং কালু ও নজু কর্তৃক খোদেজাকে নিপীড়ন করে ব্রিজ থেকে বের করে দেওয়া- এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় নাটকটি।

পরবর্তী দৃশ্যকল্পে পতিতাকে কাছে না পেয়ে চাক্কু মজিদ, ফতির ছোট শিশু পুত্রকে চুরি করার ধান্দা করে। শিশু বিক্রি করে অনেক টাকা পাবার লোভে চাক্কু মজিদ স্বপ্ন দেখে নিমতলীর প্রিন্সেস শিউলি বালার সঙ্গে নাচ গানের আসরে গিয়ে মাতলামি করার। এর মধ্যে আধপাগলী দুলির অনুপ্রবেশ ও তার সঙ্গে চাক্কু মজিদের ঝগড়া। প্রথমে চাক্কু মজিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েও না পেরে সবার কাছে উপেক্ষিত দুলির বিকৃত প্রলাপ শুরু হয়। কিন্তু ফতির বাচ্চাকে চুরি করতে দেখে দুলির ভেতরে ‘মাতৃত্ব’ জেগে ওঠে। বাচ্চাটি দুলির না হলেও, দুলি তার সমস্ত শক্তি দিয়ে মাতাল চাক্কু মজিদের কাছ থেকে শিশুটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপন যুদ্ধ করতে থাকে। এ যুদ্ধে বিজয়ী হতে দুলি পাগলি দেবীমা কালীদুর্গার মতো সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যায়। পরিশেষে দুলির ভেতরে অশুভ শক্তি বিনাশের প্রেরণা জাগরণের মধ্য দিয়ে নাটকটির পরিসমাপ্তি ঘটে।

‘আর্তনাদ’ : একজন মা এবং প্রতিবন্ধীর নির্মম বাস্তবতার গল্প

সমাজে প্রতিবন্ধীদের অসহায়ত্ব, সমাজে ঝাপটে ধরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশের আড়ালে একজন মায়ের ধূর্ত আর্তনাদ ফুটে উঠেছে নাটকটিতে। ‘আর্তনাদ’ যৌথভাবে রচনা করেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৃতীয় বর্ষের নুসরাত জাহান এবং দ্বিতীয় বর্ষের ইফফাত আরা নিশিতা। এ নাটকে প্রতিবন্ধী চরিত্র অভিনয় করেছেন মানিক (ইয়াকুব)।

নাটিকার সূচনা, ক্লাইমেক্স, এন্টি-ক্লাইমেক্স, ফলডাউন এবং পরিসমাপ্তি ছিল অনবদ্য। আঞ্চলিক ভাষা ও উদ্ভূত পরিস্থিতির আদলে ফুটে উঠেছে সমাজের একটি নির্মম বাস্তবতা; একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে একজন মা সন্তানকে নিজ হাতে খুন করার করুণ কাহিনি।

সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে অনাগত সন্তানকে ঘিরে বাবা-মায়ের কতশত আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। স্বপ্ন বুনেন অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ কীভাবে সুন্দর করা যায়। কিন্তু সন্তান যখন প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়, তখন পাড়া-মহল্লাার সব মানুষ ওই সন্তানকে অভিশাপ, বোঝা মনে করলেও মা কিন্তু সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না। পরম যত্নে আগলে রাখেন সন্তানকে। ফলে একদিকে সন্তানকে যেমন সমাজের মানুষের বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হয়, সঙ্গে তার মাকেও নানা কটু কথা সহ্য করতে হয়। সর্ব দোষ যেন মায়েরই। সবাইভাবে মা পাপী তা না হলে এমন সন্তান হয় কারো!

যারা মানসিক প্রতিবন্ধী, তারা যে সমাজে বঞ্চিত হচ্ছে এ বিষয়টি তারা বুঝতে পারেন। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা কিন্তু সমাজের বিষয়গুলো বুঝতে পারে। তারা তাদের সমবয়সিদের খেলতে দেখে ও খেলতে পারে না। অন্য ৮/১০টা বাচ্চার মতো স্কুলে যেতে পারে না। এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর পাশাপাশি তাকে বিভিন্ন টিজিংয়ের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবন্ধীদের এ কষ্টগুলোই ‘আর্তনাদ’ নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া নাটকের একটি অংশে গ্রামীণ তান্ত্রিক চিকিৎসা নামক কুপ্রথাও দেখানো হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবন্ধী ছেলের কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে নিজ হাতে খুন করার মাধ্যমে ‘আর্তনাদ’ নাটকের যবনিকা যটে।

নাটক মঞ্চায়ন শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন কুবি উপাচার্যসহ অন্য অতিথিরা। পুরস্কার বিতরণী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘নাটক সমাজের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে। এখানেও আজকে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকগুলো সেটিই করেছে। প্রতিটা নাটকেই আমাদের জন্য একটা মেসেজ থাকে। সেই মেসেজটা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়াই যেন আমাদের দায়িত্ব হয়।’

এ সময় ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহা. হাবিবুর রহমান এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক এন এম রবিউল আউয়াল চৌধুরী বিশেষ অতিথি ছিলেন। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন, বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাহিদা বেগম, উদীচী কুমিল্লার সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close