মো. জাহানুর ইসলাম
ঢাবিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেও ডেলিভারি বয়
কোনো পেশাই ছোট নয় কথাটি যত সহজে বলা যায়, তত সহজে তা মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন। বর্তমানে যারা এই চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অহিদুল ইসলাম ওয়াহিদ অন্যতম। অহিদুল ইসলাম ওয়াহিদ উত্তরের জেলা রংপুরের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন তিনি। প্রচণ্ড রকমের মেধাবী হওয়ায় অনেক ঝড়-ঝাপটায়ও ভেঙে না পড়ে লেখাপড়াটা চালিয়ে নিয়েছেন। বিপদে বিচলিত না হয়ে দৃঢ় মনোবল ও আত্মপ্রত্যয়ী প্রচেষ্টার পুরস্কারস্বরূপ এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে প্রথমবারের প্রচেষ্টায় ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারেন উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ তার জন্য নয়। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয় পরিবর্তনের আবেদন করেন। আবেদন গৃহীত হলে ভর্তি হন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। এখানেও আগের মানসিক অবস্থার কোনো হেরফের না হওয়ায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। ফলাফল আগের মতোই চমকপ্রদ। এবার ভর্তি হন আইন বিভাগে। প্রথম কয়েক মাস খুব আন্তরিকতার সঙ্গে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলেও কয়েক মাস যেতে না যেতেই সেই আন্তরিকতায় ছেদ পড়ে। বুঝতে পারেন আইনের লেখাপড়াও তাকে টানছে না। যত দিনে এটা বুঝতে পারেন, তত দিনে বিষয় পরিবর্তনের সময় শেষ হয়ে গেছে। ফলে কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে এক রকম বাধ্য হয়েই আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ফলাফল আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি সন্তোষজনকই ছিল।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে অন্য সবার মতো তিনিও নেমে পড়েন চাকরির পরীক্ষাযুদ্ধে। পরীক্ষায় প্রথম দিকে খারাপ করলেও পরে ধীরে ধীরে ভালো করা শুরু করেন। চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতি যখন মোটামুটি শেষ দিকে, তখনই মড়ার উপর খরার ঘাঁ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে করোনা মহামারির। এই সময়টায় লেখাপড়া ঠিকমতো করতে না পারায় পিছিয়ে পড়েন তিনি। করোনা মহামারি শেষ হলে আবারও জোর প্রচেষ্টা চালান কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একদিকে চাকরি হচ্ছিল না, অন্যদিকে অর্থের সংকট। তার ওপর বাড়িতে বাবা অসুস্থ। ত্রিসংকটে হতাশার মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকেন তিনি। এমতাবস্থায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেই প্রতিষ্ঠানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও বেতন পেতেন খুবই সামান্য। পরিশ্রম অনুপাতে কাঙ্ক্ষিত মজুরি না পেয়ে কয়েক মাস পর চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু একটা করার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত বছরের রমজান মাসে ছোট্ট একটা টেবিলে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের অভ্যন্তরে ইফতারি বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু বিধিবাম। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রচেষ্টা প্রথমযাত্রায় হোঁচট খায়। প্রথম দিনেই হল কর্তৃপক্ষ থেকে তার ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা হতাশ হলেও বিচলিত না হয়ে আবার নতুন করে পরিকল্পনা সাজান। আর এতেই যেন তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে।
নতুন পরিকল্পনামাফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও এর আশপাশে অবস্থান করা মানুষজনের হাতে সাশ্রয়ীমূল্যে ভালোমানের খাবার তুলে দিতে খাবারের অর্ডার নেওয়া এবং তা নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি দিতে ‘DU FOOD POINT’ নামে একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ডিউ ফুড পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন দুপুর ও রাতের জন্য সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মাটন কাচ্চি, বিফ তেহারি, বিফ খিচুরি, মোরগ পোলাওসহ নানা ধরনের খাবারের অর্ডার নেওয়া ও ডেলিভারি দেওয়া হয়। প্রথমদিকে তিনি একাই অর্ডার নেওয়া ও ডেলিভারি দেওয়ার কাজটি করলেও বর্তমানে খণ্ডকালীন চাকরি হিসেবে আরো ১০ জন তার অধীনে কাজ করছেন। ডিউ ফুড পয়েন্টের সার্ভিস সম্পর্কে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ডিউ ফুড পয়েন্টের গ্রাহক শান্ত পরানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ডিউ ফুড পয়েন্ট থেকে ছাত্রবান্ধব বাজেটে বিভিন্ন খাবার আইটেম পাওয়া যায় এবং খাবারের স্বাদও অনেক ভালো। অর্ডার নিশ্চিত হলে ডেলিভারি সার্ভিসটাও খুব দ্রুতই পাওয়া যায়। মোটের ওপর মন্দ নয়।’ ‘ডিউ ফুড পয়েন্ট’-এর মালিক অহিদুল ইসলামের কাছে তার উদ্যোক্তা হওয়া সম্পর্কে তিনি জানান, খুব আর্থিক সমস্যায় পড়ে কোনো উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে এই ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম। বর্তমানে অনেক ভালো আছি। প্রতি মাসে সব খরচ মিটিয়ে নিচে অর্ধ লাখেরও বেশি টাকা আয় করতে পারছি। এতে আমি অনেক খুশি। তবে আত্মীয়স্বজন আমার এই উদ্যোক্তা হওয়াটা এখনো ভালোভাবে নিতে পারেনি। তাদের ঘুরেফিরে একটাই কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে আমি চাকরি করছি না কেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে চাই, নিজেকে নতুন করে গড়তে চাই। আমি জানি, আমার এই পথচলা খুব সহজ ও মসৃণ হবে না। তবে আমি নিজের সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সামনে যতই কণ্টকাকীর্ণ পথ আসুক না কেন আমি সহসাই এই পথ থেকে সরে দাঁড়াবো না। অগ্রসারিত পথে ছড়ানো-ছিটানো কণ্টক সরিয়ে সেই পথে পুষ্প ফুটাতে চাই। ফুলেল সুবাসের মনোমুগ্ধকর গন্ধ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘খাবারের ব্যবসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রচণ্ড চাপের। একটু এদিক-সেদিক হলেই সর্বনাশ। সবকিছু সামলিয়ে ব্যবসাটা আরো বড় করতে চাই। বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। বেকারত্ব দূরীকরণে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের দরকার। বেকারদের জন্য কীভাবে বেশি বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা যায় এখন প্রতিনিয়ত সেটা নিয়েই চিন্তা করছি।’
অহিদুল ইসলামের কথা শুনে ইচ্ছাশক্তির কথা বারবার মনে পড়ছিল। সত্যি বলতে ইচ্ছাশক্তিই মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, ইচ্ছাশক্তি মানুষকে প্রতিনিয়ত কর্মে সক্রিয় রাখে। আর এই ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই মানুষ কখনো কখনো অসাধ্যকেও সাধন করে ফেলে। মূলকথা, ইচ্ছাশক্তিই মানুষের মূল চালিকাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো কাজ করা সম্ভব। বর্তমান সময়ে অহিদুল ইসলাম ওয়াহিদের বাস্তব উদাহরণ।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"