মো. রায়হান আবিদ, বাকৃবি

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আস্থার নাম বাকৃবির ডেইরি ফার্ম

স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভূমিষ্টের পর তার প্রথম খাদ্যই হচ্ছে দুধ। স্নেহাধার মমতাময়ী মা থেকেই শিশু প্রথম দুধ পেয়ে থাকে। তাই মায়ের তুলনা মা নিজেই। দুধ পুষ্টিকর সুষম খাদ্য হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে শর্করা, প্রোটিন, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন ও মিনারেলস। কালের পর্যায়ক্রমে মানুষের মাঝে এই দুধের চাহিদাও বেড়েছে। তেমনি দুধের বিকল্প ও স্থায়ী উৎসের খোঁজ করেছে। সেই থেকেই ডেইরি ফার্মিং বা দুগ্ধ খামারের যাত্রা শুরু। বলা যায়, ডেইরি ফার্মিং হলো দুধের দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনের জন্য একটি বিশেষ ধরনের কৃষি।

বাংলাদেশে দুধের স্থায়ী উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) একটি পরীক্ষামূলক ডেইরি ফার্ম স্থাপন করা। বাংলাদেশে এর আগে কোনো পরীক্ষামূলক ডেইরি ফার্ম স্থাপন দেখা যায়নি যেখানে পড়াশোনার ও গবেষণার পাশাপাশি আধা-বাণিজ্যিকরণ ব্যবস্থা রয়েছে। ৭৪.১৬ একর জমি নিয়ে স্থাপিত এই ফার্মটিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পশু বিজ্ঞানীদের ব্যবহারিক পড়াশোনার পাশাপাশি চলে বিভিন্ন গবেষণা। এছাড়া সামাজিক সেবামূলক কাজও ফার্মটি করে থাকে। এখানে কৃষক ও উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। ব্র্রাক, যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও এখানে শিখতে আসে সাথে সাথে ভ্রমণেও আসে। ফার্মটি থেকে প্রায় পাঁচশ পরিবার দুধ সংগ্রহ করে। এছাড়া এখান থেকে দই এবং ঘি দেশের নানা প্রান্তে চলে যাচ্ছে।

ফার্মটিতে ৫ দশমিক ২০ একর জমিতে পশু রাখার জন্য বিভিন্ন স্থাপনা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে। আর ৬৭ দশমিক ৪৬ একর জমি চাষাবাদের জন্য এবং বাকি ১ দশমিক ৫০ একর জমি পুকুরের জন্য।

ডেইরির প্রথম ইতিহাস পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম সহ¯্রাব্দের শুরুর দিকে নিওলিথিক যুগে ইউরোপ এবং আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে। ২০ শতকের আগে ছোট ছোট খামারগুলোতে হাত দিয়ে দুধ দুয়ানো হতো। তবে শেষের দিকে, রোটারি পার্লার, মিল্কিং পাইপলাইন এবং ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠে স্বয়ংক্রিয় মিল্কিং সিস্টেম সহ নানা প্রযুক্তি। উদ্ভাবিত বিশাল বিশাল ডেইরি ফার্ম স্থাপনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশে শুরু হয় ডেইরির বাণিজ্যিকীকরণ।

ফার্মটিতে দুগ্ধজাত প্রাণি পালনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। এই ফার্মটিতে প্রায় আড়াইশ (২৫০) দুগ্ধজাত প্রাণি পালন করা হচ্ছে। এই খামারে কোনো পিওর জাতের দুগ্ধ গাভী নেই তবে তাদের বেশির ভাগই হলস্টেইন বা জার্সির সাথে সিন্ধি অথবা শাহিওয়ালের ক্রসব্রীড বা সংকরায়ন করা হয়েছে এমন পশু। এছাড়াও রেড-চিটাগাং ক্যাটেল (আরসিসি) এই খামারে পাওয়া যায়। এছাড়াও কিছু মহিষ ক্রসব্রীড র্মুরাহ ও নীলি রাভি দুধের উদ্দেশ্যে রাখা হয়।

এই ফার্মের মূল উদ্দেশ্য হল দক্ষ ছাত্র এবং প্রশিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করা যাতে তারা এদেশের গবাদি পশুর উন্নয়নে কাজ করতে পারে। এই ফার্মটি ডেইরি সাইন্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা পরিচালনাসহ স্নাতক ডিগ্রি ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া ডেইরি সাইন্সে পিএইচডি করার সুযোগও রয়েছে। বর্তমানে ডেইরি ফার্মের পরিচালনায় দায়িত্বরত আছেন ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাদাকাতুল বারি।

বাকৃবির এই ডেইরি ফার্মটিতে গবাদি পশুর জন্য বিশাল অংশ জুড়ে পশু খাদ্য চাষ করা হয়। চাষের জমিতে নেপিয়ার, প্যারা ঘাস ও জার্মান সারাবছর পাওয়া যায়। এছাড়া মৌসুমি ফসল ভুট্টা, সরিষা, ওটস্, জাম্বো, মাটিকালাই, খেসারি এবং ধৈনঞ্চা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পশুখাদ্য চাষ করা হয়।

বর্তমান ফার্মে ৫০টি মহিষ খামারের দুধ উৎপাদন ও বিবিধ কাজের উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে। এই খামারের আয়ের উৎস হল দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন দই, চিজ ও ঘি, আধিক্য পশু ও বাছুর বিক্রি, জৈব সার এবং উন্নত জাতের ঘাসের বীজ ও ঘাসের কাটিং। ফার্মটিতে দৈনিক প্রায় ২৫০-৩৭০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। বছরে প্রায় পঁচাশি-নব্বই হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করে এই খামারটি। খামারটিতে দৈনিক পশুখাদ্য লাগে প্রায় আট হাজার কেজি।

এই ফার্মটি থেকে উৎপাদিত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আশাপাশের এলাকাগুলোতেও চলে যায়। এছাড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও ফার্ম থেকে দুধ সংগ্রহ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার, গষেণার পাশাপাশি বছরে এই ফার্মটি থেকে প্রায় একাত্তর লাখ টাকার আয়ও করে থাকে। এই ফার্ম থেকে প্রাপ্ত দুধের গুণাগুণ যেমন ভালো তেমনি দুধের ফ্যাট পার্সেন্ট প্রায় ৪ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ যা সাধারণ দুধের ফ্যাট পার্সেন্ট ৩ দশমিক ৫ থেকে অনেক বেশি। খুবই স¦াস্থ্যকর উপায়ে সংগ্রহ করা হয় এই দুধ। এখানে দুধের প্রতি লিটার দাম মাত্র ৭০ টাকা। এত সস্তায় আশেপাশে কোথাও দুধ পাওয়া যায় না। তাই তো প্রতিদিন অনেক দূর থেকেও দুধ নিতে আসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close