সেলিম খান

  ১৪ এপ্রিল, ২০২২

বৈশাখ স্বাধিকার থেকে স্বাধীন বাঙালিয়ানার বাহন

উৎসব মাত্রই সামষ্টিক আনন্দের প্রকাশ। আর সেই উৎসবটি যদি হয় একটি জাতির হয়ে ওঠা সংগ্রাম, প্রতিবাদের মতো নিজেকে জানান দেওয়ার অনুষঙ্গের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাহলে তো কথাই নেই। সেই উৎসবে থাকে না কোনো ভেদ, থাকে না কোনো প্রভেদ, থাকে না কোনো ধর্মণ্ডবর্ণ কিংবা গোত্র বিভাজন। যার অনিবার্যতা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। সেই উৎসব হয় সবার। তেমনি একটি উৎসব আমাদের বাংলা নতুন বছর বরণের দিন। পহেলা বৈশাখ।

এই বৈশাখের প্রচলনটা কীভাবে এলো তা নিয়ে রয়েছে খানিকটা বিতর্ক। আসলে বাঙালি জাতির ইতিহাসের মতো বাংলা সনের ইতিহাসও নানা অস্পষ্টতায় ভরা। রাজা শশাঙ্ক, না কি সুলতান হোসেন শাহ, না কি সম্রাট আকবর- বাংলা সন চালু করেছেন। সেই বিতর্কের এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সমাধানে আসতে পারেননি সংশ্লিষ্ট প-িত-গবেষকরা। তবে শাব্দিক উৎস বিবেচনায় ‘সাল’ শব্দটি ফারসি আর ‘সন’ শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আর এই শব্দ দুটো বঙ্গাব্দের সঙ্গে যুক্ত থাকায় মনে করা হয় যে, কোনো না কোনোভাবে মুসলমান সুলতান বা সম্রাটদের সময়েই প্রচলন হয়েছে বাংলা সনের। সেদিক থেকে সুলতান হোসেন শাহকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন অনেকেই। কেননা সুলতানি সময়েই দেশ-নাম ও জাতীয়তার ক্ষেত্রে বঙ্গ, বাঙালা বা বাঙালিত্ব একটা সুস্পষ্ট ও দিকনির্দেশক ভাবনা হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। যেমন সে সময় সুলতানদের অনেকেই নিজেদের ‘শাহানশাহে বাঙলা’ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তবে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জীবনাচার, কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো প্রভৃতি ভিত্তি ধরে সম্রাট আকবরই যে বাংলা সন চালু করেন, সে দাবি অনেকটাই জোরালো। এ ছাড়া বাংলা সন বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন বিশ্বখ্যাত বাঙালি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ১৯৯৮ সালের আগস্টে দিল্লিতে ‘বিগত শতাব্দীর মূল্যায়ন’ শীর্ষক বক্তৃতায় ডক্টর সেন সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে দাবি করেন। বলেন, ১০০০ হিজরি সালকে ভিত্তি ধরে আকবর ভারতীয় সন সংস্কারের যে পরিকল্পনা করেন, তারই ফল হচ্ছে হিজরির সঙ্গে সমন্বিত বাংলা সন; যা তিনি ৯৯৩ হিজরিতে সংস্কার করে তার রাজ্যাভিষেকের বছর ১৫৫৬ থেকে সৌর সন হিসেবে চালু করেন।

তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, কয়েক শ বছর ধরেই কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলে বাংলা সন বা সাল চালু ছিল এবং এখনো আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এ বাংলা সন বা সাল যাই বলি না কেন, তা প্রচলনের পেছনে সব থেকে বেশি কাজ করেছে রাজার খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্য- এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কেননা বছরের এ সময়টায় কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলের মানুষের গোলায় ওঠে নতুন ফসল। তাই এ সময়টাকে খাজনা আদায়ের মোক্ষম বিবেচনায় এমন বছর ব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয় প্রজাদের কাছে; যাতে তারা একটু আয়েশে রাজার কোষাগারে জোগান দিতে পারেন। তবে প্রজারা শুধু খাজনা দিয়ে খালি মুখে রাজদরবার থেকে বিদায় নেবেন, তা কী করে হয়। সেজন্য বছর শুরুর এদিনে খাজনা আদায়ের পাশাপাশি থাকত খানিকটা মিষ্টিমুখ করার ব্যবস্থা। প্রজাদের খাজনার অর্থ দেওয়ার জন্য রাজদরবারে থাকত বিশাল রুপোর থালা। আর তার পাশেই থাকত মিঠাই-মণ্ডার ডালা। খাজনা দিয়ে রাজার প্রতি কৃতার্থ হওয়ার পাশাপাশি প্রজারা একটু মিষ্টিমুখ করে হাসিমুখে বিদায় নিতেন রাজবাড়ী থেকে। শুধু কি তাই, রাজবাড়ীতে যেতে হবে। সেজন্য তো চাই নতুন কাপড়, নতুন সব সাজসজ্জা। একই সঙ্গে রাজ উদ্যোগেই হতো নানা রঙিন আয়োজন। গ্রামীণ বাংলায় রাজরাজরা কিংবা সমাজপতিদের উদ্যোগে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠান হলেও একেক অঞ্চলে তা ছিল একেক ধরনের। কোথাও এমন আয়োজনের প্রধান অনুষঙ্গ পারিবারিক আমানি উৎসব, কোথাও ঘোড়ার দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, কোথাওবা মোরগযুদ্ধ, নানা ধরনের মেলা, গ্রামীণ খেলাধুলা প্রভৃতি। আর এসব আয়োজন প্রজাদের তাদের কষ্টার্জিত অর্থ রাজকোষে দেওয়ার যন্ত্রণাটা কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দিত বৈকি।

বলাই বাহুল্য, রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় এমনি সব আয়োজন ধীরে ধীরে স্থায়ী জায়গা করে নেয় বাঙালির যাপিত জীবনে। এমনিতেই বারো মাসে তেরো পার্বণের মানুষ এ অঞ্চলের। তার ওপর রাজ আয়োজন সে সবে যোগ করে উৎকর্ষের মাত্রা। সময়ের বিবর্তনে পাল্টায় রাষ্ট্রব্যবস্থা, পাল্টে যায় অর্থনৈতিক কাঠামো। থেকে যায় বাঙালির জীবনে যুক্ত হয়ে যাওয়া সব আনন্দ অনুষঙ্গ। আর সেসব অনুষঙ্গ হচ্ছে বাঙালির খাদ্য-খাবার, বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদ, বাঙালির চলাফেরা, বাঙালির আচার-আচরণ, বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষা, বাঙালির অন্যকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা- এক কথায় দেশ-সমাজে বাঙালির নিজেকে উপস্থাপিত হওয়ার মানসম্মত প্রয়াস। আর এমনি সব প্রয়াস মিলিয়ে জন্ম নেয় বাঙালিয়ানা। সময়ের ধারাবাহিকতায় এ বাঙালিয়ানাকে কাঠামোবদ্ধ করতে, বিশ্বমান দিতে, তাকে ঋদ্ধ করতে নানাভাবে অবদান রেখেছেন রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এমনকি এ সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের মতো আধুনিক মানুষরা। বাঙালির ভাবনার জগৎকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি এসব মানুষ বাঙালিকে দিশা দিয়েছেন আধুনিক হওয়ার। তা সে আচার-আচরণেই হোক, পোশাক-পরিচ্ছদেই হোক, ফ্যাশন কিংবা স্টাইলেই হোক, রাষ্ট্র অথবা রাজনীতিতেই হোক- যাপিত জীবনের সবটাইতে বাঙালি হয়ে ওঠার প্রয়াস জুগিয়েছেন এসব মানুষ। রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন শুধু এ বঙ্গের মানুষকেই নয়, গোটা ভারতবাসীকে সাহস আর দিশা দিয়েছে সব কুসংস্কার, জরাজীর্ণকে পেছনে ফেলে সভ্যতার বাহনে চড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বাঙালিকে তাদের সঙ্গে। বাঙালির প্রেম, বাঙালির দ্রোহ, বাঙালির ফ্যাশন, বাঙালির স্টাইল, বাঙালির সংগ্রাম, বাঙালির রাজনীতি সবটাতেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ঋদ্ধ উপস্থিতি। আর বাঙালিকে জাতি হিসেবে রাজনৈতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার সংগ্রামী নেতৃত্বে বাঙালি পেয়েছে স্বাধীনতা, পেয়েছে স্বাধীন একটি পতাকা, স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। বাঙালি সাহসী হয়েছে বিশ্বদরবারে নিজেকে সদর্পে উপস্থাপিত করার। যে রাষ্ট্রে বাঙালির সুযোগ হয়েছে স্বাধীনভাবে তার বাঙালিয়ানা চর্চার। এমনি সব মহাপুরুষের দার্শনিক চেতনা, দিশা-নির্দেশনা আর ভাবনায় সমৃদ্ধ বাঙালির বাঙালিয়ানা হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় আজ সর্বজনীন, সর্বজনগ্রাহ্য। আর এই সর্বজনীনতা ও সর্বজনগ্রাহ্যতার সামষ্টিক প্রকাশ ঘটে বাঙালির উৎসবে পার্বণে। সংকোচহীন সাহসে যেসব উৎসব পার্বণে বাঙালির উপস্থিতি ঘটে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ভাষা নির্বিশেষে। অন্যসব উৎসবে তো বটেই, বিশেষ করে নতুন বছর বরণের দিন পহেলা বৈশাখে বাঙালিয়ানা পায় অন্যমাত্রা অন্য আঙ্গিক। যার প্রকাশ ঘটে বাঙালির সাজসজ্জায়, যা বৈশাখী সাজ, খাদ্য-খাবারে বৈশাখী খাবার, বৈশাখী পোশাক-পরিচ্ছদে- এমনি আরো কত কী।

শুধু যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ বিনির্মাণেই আটকে নেই বাঙালির বৈশাখ। বাঙালির নিজে ভালো থাকার এমনকি অন্যকে ভালো রাখার প্রয়াস, যাবতীয় অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রয়াসে বৈশাখের অন্যতম আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা। অন্যায়-অনাচারকে প্রতিবাদের আগুনে ভস্মীভূত করে জরাজীর্ণকে পেছনে ফেলে শুভ্র, মঙ্গলকর আর সুন্দর সবটাকে সঙ্গী করে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির জীবনকে এগিয়ে নেয় সব প্রতিকূলতার অতিক্রান্তে। এ মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ বাঙালির কাছে বৈশাখী কল্যাণের বাহন, প্রতিবাদের বাহন তো বটেই।

তাই তো আমরা দেখি এ বাংলায় বিশেষ করে ঢাকায় বৈশাখকে প্রতিবাদের অনুষঙ্গ কিংবা ধর্মের রাষ্ট্রিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সর্বজনীন একটি মাধ্যম হিসেবে নতুনভাবে সজ্জিত করার প্রয়াসের শুরুটা পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র সৃষ্টির অব্যাহতি পর থেকেই। যার পথচলা শুরু হয় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী তৎপরতার হাত ধরে। এ সম্পর্কিত ১৯৫৪ সনের কিছু তথ্য মেলে সরলানন্দ সেনের ঢাকার চিঠি বইয়ে। ১১ এপ্রিল ডেটলাইনে লেখা ওই চিঠিতে সরলানন্দ লিখছেন, ‘পয়লা বৈশাখ হিন্দু-মুসলমান প্রত্যেক বাঙালির প্রিয় নববর্ষ দিবস। যেদিন থেকে বাঙালি সংস্কৃতির সেবার হিন্দু-মুসলমান দুই ভাই একে অপরের হাত ধরে আত্মনিয়োগ করেছে, সেদিন থেকে পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রিয় উৎসব দিবস।’ সরলানন্দ সেন তার বইয়ে আরো লিখছেন, ‘ঢাকা ১৮ই এপ্রিল : এ বছরে ঢাকা শহরে নববর্ষ দিবস উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিটি নর-নারীর মনে যে উদ্দীপনা দেখা যায়, বঙ্গ বিভাগের পর কখনো এমনটি আর দেখা যায়নি। এ সময়টায় পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের গীতিবিচিত্রা ও শকুন্তলা নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠান, পূর্ববঙ্গ লেখক সংঘ, আজিমপুর এস্টেট ছাত্রসংঘ, আমাদের বৈঠক ও পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগও নানাভাবে নববর্ষ উৎসব করে। ঢাকা ছাড়াও এসব আয়োজন ছড়িয়ে পড়ে জেলা শহরগুলোতেও। সেই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার অনুরোধ জানিয়ে বিবৃতি দেন। বলেন, আগামী ১৪ এপ্রিল বাংলার নববর্ষ শুরু হবে। এ নববর্ষ দিবস সব বাঙালির এক বিশেষ উৎসবের দিন। পূর্ব বাংলার সর্বত্র জনসাধারণ আনন্দণ্ডউৎসবের মধ্যে দিবসটি পালন করবে, সুখ ও সমৃদ্ধিপূর্ণ নতুন বছরের সংকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। ডক্টর হোসেনের এমনিতর অনুরোধ শেষ পর্যন্ত বাঙালির কাছে দাবিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন মহলে নানা অনুষ্ঠানে দাবি উঠতে থাকে পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করার। এভাবেই কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আকাশটা যুক্ত হয়ে যায় বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সহযাত্রী সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আদায়ের প্রশ্নের সঙ্গে। এরই মধ্যে ১৯৫৮-তে জারি হয় সামরিক শাসন। আপাত স্তিমিত হয়ে পড়া সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এমনি সব উপায় গিয়ে জড়ো হয় বাংলার পশ্চিম আকাশে। পথ খুঁজতে থাকে কালবৈশাখী হয়ে সবকিছু তছনছ করে দেওয়ার। পরে ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী ও ছায়ানটের রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উজ্জীবিত করে সংগ্রামের পথকে। যারই ধারাবাহিকতা বাঙালির জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হয়ে আনে স্বাধীনতা, আনে মুক্তি, আনে বাংলাদেশ। আর এখন তো বাঙালির বৈশাখ আর বাঙালিয়ানা বিশ্বমাঝে নানারূপে, নানা সৌকর্যে, নানা মুগ্ধতায় উদ্ভাসিত, উচ্ছলিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close