আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ২২ মে, ২০২৪

অনিশ্চয়তার পথে ইরানের ভবিষ্যৎ

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে দেশটিতে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দেশটির ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের খুব কাছাকাছি ছিলেন রাইসি। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উত্তরসূরি তিনিই হবেন এমনটাও প্রবলভাবে মনে করা হচ্ছিল। তবে একটি নাটকীয় মোড় সব হিসাবনিকাশই যেন পাল্টে দিল। খবর বিবিসির। রাইসিকে একজন কট্টরপন্থি ধর্মীয় নেতা হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। এ কারণে তিনি সরকার-বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখেও পড়েছেন। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় তিনি কঠোর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।

অনেকে মনে করেন, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা তাকে বিচার বিভাগের প্রধানের শক্তিশালী পদে নিযুক্ত করেন। বিশেষজ্ঞদের অ্যাসেম্বলির ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট রাইসি। ইরানে ৮৮ সদস্যের এই বোর্ড দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে।

ইরানের কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্টের এই করুণ পরিণতিতে সে দেশের নীতি অথবা ইসলামি প্রজাতন্ত্রে কোনো গুরুতর ঝাঁকুনি দেবে, তেমনটা মনে করা হচ্ছে না। তবে এ ঘটনা এমন একটা ব্যবস্থাকে পরীক্ষায় ফেলবে, যেখানে রক্ষণশীল কট্টরপন্থিরা (নির্বাচিত হোক বা অনির্বাচিত হোক) ক্ষমতার সব ক্ষেত্রেই আধিপত্য বিস্তার করে।

চ্যাথাম হাউস থিংক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক ড. সানাম ভাকিল বলেন, এই ব্যবস্থা তার (ইব্রাহিম রাইসির) মৃত্যুকে ব্যাপকভাবে প্রদর্শন করবে এবং তার কার্যকারিতা দেখানোর জন্য সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনে চলবে। এর পাশাপাশি এমন একজনেরও খোঁজ চালানো হবে, যিনি খামেনির প্রতি আনুগত্য দেখাবেন এবং একই সঙ্গে রক্ষণশীল ঐক্য বজায় রাখতে পারবেন।

১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের যেভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে রাইসির ভূমিকা নিয়ে বহু ইরানি এবং মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যদিও ইরান কখনো এই গণ-মৃত্যুদণ্ডের কথা স্বীকার করেনি এবং এতে রাইসির ভূমিকা নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কখনো কিছু বলেননি। ফলে তার প্রস্থানকে বিরোধীরা স্বাগত জানাবে বলেই মনে হচ্ছে।

তার বিরোধীরা এটাও আশা করবে যে, ইব্রাহিম রাইসির প্রস্থান রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থার অবসান ত্বরান্বিত করবে। ইরানের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীলদের জন্য ইব্রাহিম রাইসির প্রস্থান অনেকটা আবেগে ভরা উপলক্ষ হতে চলেছে বলেই মনে করেন ড. সানাম ভাকিল। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর রক্ষণশীলরা যে শাসন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত সে বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে সংকেত পাঠানোরে সুযোগও তৈরি হবে। তারা জানে গোটা বিশ্ব তাদের ওপর নজর রাখছে।

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্দি বলেছেন, কয়েক বছর ধরে পশ্চিমাদের ভাষ্য মতে, ইরানের পতন হওয়ার এবং ভেঙে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি এবং আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, আগামী বছরগুলোতেও এমনটাই থাকবে।

ড. ভাকিল বলেন, রাইসি একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি ছিলেন। কারণ খামেনি নিজে যখন শীর্ষ নেতা হয়েছিলেন সে সময় তিনিও তুলনামূলকভাবে তরুণ ছিলেন, ভীষণ অনুগত, ব্যবস্থাপনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, যার ব্যাপক পরিচিতিও ছিল। রাইসিও তাই ছিলেন।

রাইসির মৃত্যু আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার আগেই আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সামাজিক মাধ্যমে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, ইরানি জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়, দেশের কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। তবে এই মুহূর্তের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা। ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবেরের কাছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে।

২০২১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইব্রাহিম রাইসি। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে তদারকি সংস্থা দ্বারা মধ্যপন্থি এবং সংস্কারপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বীদের পদ্ধতিগতভাবে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ইব্রাহিম রাইসির পদমর্যাদারও সুস্পষ্ট কোনো উত্তরসূরি দেখা যাচ্ছে না। বার্লিনভিত্তিক থিংক ট্যাংক এসডব্লিউপির ভিজিটিং ফেলো হামিদরেজা আজিজি বলেন, এই রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন শিবির রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আরো কট্টরপন্থি আর বাকিদের তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী বলে মনে করা হয়।

আজিজি মনে করেন নতুন সংসদে এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার লড়াই শিগগির আরো বেশি জোরদার হয়ে উঠবে।

ইরানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা শীর্ষ নেতার হাতে। এই অঞ্চলের পররাষ্ট্রনীতি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সংরক্ষণ তাদের হাতে যারা ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তির প্রয়োগ করে।

গাজা যুদ্ধ নিয়ে মাসখানেক আগে ইসরায়েলের সঙ্গে নজিরবিহীন সংঘর্ষের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট রাইসি কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানা যায়। ‘আঘাতের বদলে আঘাত’ এই নীতি অনুসরণ একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বিশেষত তেহরানে তীব্র বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব দেখা যায় ব্যবসা-বাণিজ্যে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। দেশটিতে ৪০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, মুদ্রার মান কমেছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের কঠোর পোশাকবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নীতি পুলিশের হাতে ২২ বছরের মাহশা আমিনের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভের ঢেউ পরিস্থিতি বেশ অশান্ত করে তুলেছিল।

এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট রাইসি ইরানের হিজাব আইন কঠোর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আইনে নারীদের হিজাব পরা, শালীন আচরণ ও পোশাক পরার বাধ্যবাধ্যকতার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

কিন্তু তরুণ প্রজন্মের নারীরা তাদের জীবনের ওপর জোর করে আরোপ করা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। শীর্ষ নেতা এবং দেশের ব্যবস্থার ওপর ক্ষোভ উগরে দেন তারা। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বিক্ষোভ দমন করতে চালানো অভিযানে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছেন আরো কয়েক হাজার মানুষ।

সংস্কারপন্থি নেতা হাসান রুহানির কথা উল্লেখ করে শাবানি বলেন, ইরানের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার নজির সৃষ্টি হয়েছিল রাইসির নির্বাচনের সময়। তিনি কিন্তু তার পূর্বসূরি রুহানির মতো জনপ্রিয়তা পাননি।

হাসান রুহানি মূলত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পিছু হটে যাওয়ায় ওই চুক্তি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন এবং ইব্রাহিম রাইসির টিমের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

শাবানি ব্যাখ্যা করেছেন, রুহানির প্রতি ইরানে বিরোধীদের ক্রোধ এড়াতে পেরেছিলেন রাইসি। এর আংশিক কারণ তাকে অপেক্ষাকৃতভাবে কম প্রভাবশালী এবং কার্যকর হিসাবে দেখা হয়েছিল।

বোর্স অ্যান্ড বাজার থিংক ট্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসফানদিয়ার ব্যাটমানঘেলিজ বলেন, একজন প্রেসিডেন্টের আকস্মিক মৃত্যু সাধারণত একটি পরিণতিমূলক ঘটনা। সম্ভাব্য শীর্ষ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও তার রাজনৈতিক সমর্থন এবং স্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল। কিন্তু যে রাজনৈতিক নেতারা রাইসিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারা তাকে ছাড়াই এবার এগিয়ে যাবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close