প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
পুতিনের প্রধান শত্রু রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শত্রুরাষ্ট্র ও বন্ধুরাষ্ট্রের একটি তালিকা তৈরি করেছে রাশিয়া। এর ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধকালীন একেক দেশের সঙ্গে একেক ধাঁচের সম্পর্ক বজায় রাখছে দেশটি। বাইরের শত্রুর দিকে সজাগ নজর রাখলেও নিজ দেশের জনগণ ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে পুতিনবিরোধী।
প্রবাদ আছে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’, বর্তমানে পুতিনের হয়েছে এ দশা। বাইরের শত্রুর থেকেও ঘরের শত্রু দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে পুতিনের জন্য। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট রুশ নাগরিকরা রুষ্ট হচ্ছেন তাদের নেতার প্রতি।
যুদ্ধকালীন প্রথম পর্বে নিষেধাজ্ঞার বিপরীত প্রভাবে পশ্চিমা দেশগুলো পণ্যের উচ্চমূল্য পরিশোধে হিমশিম খেলেও, এখন সে অবস্থা অনেকটা কেটে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো সমস্যা কাটিয়ে উঠলেও চলতি বছর শেষের দিকে এসে রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী।
দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতিই এখন পুতিনের প্রধান শত্রু। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধের খরচ মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে পুতিনকে। সশস্ত্র বাহিনীর খরচ দিনকে দিন বাড়ছে আর এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাড়ছে দেশের মূল্যস্ফীতি।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সাধারণ মানুষের পকেটে খরচ করার মতো টাকা কমে আসছে। মস্কোর এক সুপার মার্কেটের উদাহরণ টেনে বলা হয়, তাকে খাবার সাজানো থাকলেও মানুষের পকেটে নেই টাকা। একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই বোধ করছেন রুশ নাগরিকরা।
এতে আরো বলা হয়, নভেম্বরের শেষে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশটির সুদের হার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে; যা যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হারের থেকে তিনগুণ বেশি। বর্তমানে বাৎসরিক মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ হলেও, বছরের শেষ দিকের মাসগুলোতে এসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাত দিয়ে জানা যায়, এটি হঠাৎ বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতি নয়, বরং চলমান যুদ্ধের সামগ্রিক ফসল। মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনা অনেক জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ২০২৪ সালে দেশটির বাৎসরিক মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রাশিয়ার সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরো রোসস্ট্যাটের প্রতিবেদন অনুসারে, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ হলেও দেশটির খাদ্যমূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম দিনকে দিন মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেশটিতে সবজির দাম ৭৪ শতাংশ, ফলের দাম ৭২ শতাংশ এবং সালাদের দাম ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সুপার মার্কেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এ বছর মাছ, মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। পকেটে টাকা না থাকায় কিনতে এসেও খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন অনেক ক্রেতা।
এরই মধ্যে ২০২৪-২০২৬ সালের বাজেটগুলোতে সামরিক খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার পার্লামেন্ট। সামরিক খাতে এভাবে বাজেট বরাদ্দ দিতে থাকলে দেশের ভেতরে বাড়বে অসন্তোষ এবং একসময়ে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির অর্থনীতিবিদরা।
রুশ অর্থনীতি বিশ্লেষক ম্যাক্সিম ব্লান্ট বলেন, রাশিয়া যে পথে হাঁটছে, তাতে শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো আগামী দিনগুলোতে রাশিয়ার বাজার ব্যবস্থা আরো অস্থির হয়ে উঠবে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
২০২২ সালে ডলারের বিপরীতে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান বড় রকমের পতনের পর আবার উত্থান হলেও ২০২৩ সালে টানা অবমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রুবল। গত কয়েক মাস আগেও ডলারের বিপরীতে রুবলের মান ১০০ উঠে গেলেও, সুদহার বাড়ানোয় তা ডলারপ্রতি ৮০ রুবলে নেমে এসেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেখানে ২০২২ সালে ডলারপ্রতি রুশ মুদ্রার মান ছিল ৬০ রুবল, সেখানে ১০০ থেকে ৮০ রুবলে নামা আর যা হোক কোনো সুখকর বার্তা দেয় না।
এদিকে পশ্চিমারা বলছেন, পুতিন যে পথে হাঁটছেন, তাতে দেশের মানুষের মধ্যেই পুতিনবিরোধী অসন্তোষ কাজ করবে। এখন শাস্তি এবং জেলের ভয়ে মানুষ চুপ থাকলেও যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে এ মূল্যস্ফীতি পুতিনের পতনের কারণ হবে।
মতামতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক প্রতিবেদনে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হারল্ড জেমস বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রুশ সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন, বর্তমানে পুতিন একই পথে হাঁটছেন।
১৯১০ সালের পর থেকে বলসেভিক বিপ্লব পর্যন্ত রাশিয়ায় যে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তাই রুশ সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ টেনে জেমস বলেন, যুদ্ধে রুশ বাহিনী এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল, যখন তারা আর সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিল না। একদিকে দেশের দুর্ভিক্ষ অন্যদিকে সৈন্যদের বিদ্রোহ।
রাশিয়ার কর্তাব্যক্তিদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা চিন্তা করছে রাশিয়া। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে এবং এই খাতে এ পরিমাণ জিডিপি বরাদ্দ দিতে থাকলে আগামী বছরগুলোতে পুতিনের বিরুদ্ধে নিজ দেশের মানুষের অসন্তোষ আরো ঘনীভূত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রুশ নাগরিকদের পুতিন প্রসঙ্গে বর্তমান মানসিকতা নিয়ে হারল্ড জেমস বলেন, তরুণরা চাকরি করতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। দিনকে দিন যুদ্ধের হতাশা তাদের গ্রাস করে ফেলছে। অনেক টাকা বেতন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও কর্মী পাচ্ছে না রুশ প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে করে বড় রকমের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে দেশটির অর্থনীতিতে। আর এই বিপর্যয়ের কারণেই নিজ দেশের মানুষের বিপ্লবে হয়তো পুতিনের পতনের ঘণ্টা বেজে যাবে।
"