তুহিন আহমদ, সিলেট

  ১১ জুন, ২০২৪

সিলেটে পাহাড় ধসে এক পরিবারে ৩ জনের মৃত্যু

৪০০ পাহাড়-টিলায় ১৫ হাজার মানুষের বাস * এ পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত ২৩ জন

সিলেটে গতকাল সোমবার সকালে নগরের চামেলীবাগ আবাসিক এলাকায় একটি টিলাধসে বসত ঘরে পড়েছে। এতে এক শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন মারা গেছে। আহত হয়েছেন আরো তিনজন। নগরের ৩৫নং ওয়ার্ডে এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

নিহতরা হলেন চামেলীবাগ এলাকার ২ নম্বর রোডের ৮৯ নম্বর বাড়ির রফিক উদ্দিনের ছেলে করিম উদ্দিন (৩১), তার স্ত্রী শামীমা আক্তার রোজী (২৫) এবং তাদের দুই বছর বয়সি শিশুসন্তান তানিম। ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, ঘটনার সময় সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন। সিলেটে কয়েক দিন থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল ভোরে ৩ ঘণ্টার ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে। এতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল ভারী বর্ষণে সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসের আশঙ্কা আছে।

জানা গেছে, চাপাপড়া আধাপাকা ঘরটি ছিল টিলার নিচে। ভারী বৃষ্টির কারণে টিলার বিশাল একটি অংশ ধসে ঘরটির ওপর পড়লে একটি কক্ষে মাটিচাপা পড়ে এক পরিবারের ছয়জন। পরে স্থানীয়রা চারজনকে উদ্ধার করলেও করিম, তার স্ত্রী ও শিশুসন্তান নিখোঁজ ছিল। ৬ ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। সিলেট ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের তিনটি দল উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। ৬ ঘণ্টা পর আমরা নিখোঁজ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করি।’

স্থানীয় কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ধসেপড়া বাড়িতে দুটি পরিবার থাকত। টিলাধসে চাপাপড়া ঘরের নিচে দুই পরিবারের ছয়জন আটকে পড়েছিলেন। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং আমরা এসে এক পরিবারের তিনজনকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাই। এক পরিবারের তিনজন মারা গেছে।

শাহপরান থানার ওসি মোহাম্মদ হারুনূর রশীদ চৌধুরী জানান, বৃষ্টির কারণে টিলাধসে একই পরিবারের তিনজন চাপা পড়ে মারা যান। তাদের মরদেহ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

৪০০ পাহাড়-টিলায় ঝুঁকি জেনেও বাস : ঝুঁকি জেনেও সিলেটের বিভিন্ন পাহাড়-টিলায় বাস করছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। প্রতি বছর বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে পাহাড়-টিলা ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর মাইকিং আর প্রচার চালিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয় না। জেলায় পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী লোকজনের সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। জানা গেছে, টিলা ও পাহাড়ধসে সিলেট জেলায় গত ১০ বছরে মারা গেছেন অন্তত ২০ জন। সবশেষ এই তালিকায় যুক্ত হলো আর তিনজনের নাম।

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ টিলার ওপর সেভ দ্য হেরিটেজ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, সিলেট শহরতলী ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলা কেটে পাদদেশে অন্তত ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। এরপর আর কোনো জরিপ চালানো হয়নি। বর্তমানে এ সংখ্যা অনেক বাড়ছে। কারণ টিলা কাটা তো থেমে নেই, উল্টো বাড়ছে। এ বিষয়ে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাসকারীদের নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে প্রশাসনকেই।

জানা গেছে, টিলার পাদদেশে কত মানুষের বাস সরকারিভাবে এর কোনো তালিকা নেই তবে বেসরকারি হিসাবে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার টিলার পাদদেশে বসবাস করছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্র লোকজনদের বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে। মূলত কম ভাড়ায় কিংবা বিনা ভাড়ায় থাকতে পারার কারণেই দরিদ্র শ্রেণির লোকরাই টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন। যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড়-টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার ওপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসাব মতে, সিলেট নগর, সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪০০ পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলার ওপর ও পাদদেশে অনেক পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে।

জানা গেছে, নগরীর হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরের উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানবন্দর সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসে মৃত্যুর ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জেলায় প্রায় ৪০০টি টিলা রয়েছে। অনেক টিলা আংশিকভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। এ কারণে ধসের ঝুঁকি বাড়ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের বিষয়টি মূলত জেলা ও উপজেলা প্রশাসন দেখে। আমরা টিলা কাটা বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিই, নিয়ে থাকি। গত এক বছরে অর্ধশত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান এ ব্যাপারে বলেন, টিলার ওপর ও পাদদেশে বসবাসকারীদের অনেক চেষ্টা করেও অন্যত্র সরানো যায় না। এ বছরও মাইকিং করে টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি।

ফের জলাবদ্ধ : সোমবারের ভারী বৃষ্টিতে আবারও সিলেট নগরীতে জলজট লেগে যায়। এ নিয়ে আট দিনের ব্যবধানে তিনবার ডুবল সিলেট নগরের অর্ধশতাধিক এলাকা।

সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, গতকাল সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সিলেটে ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের উপশহর, সোবহানীঘাট, তেরোরতন, মাছিমপুর, তালতলা ও শেখপাড়া এলাকায় বৃষ্টির পানি জমেছে। এসব এলাকার কোথাও কোথাও হাঁটু সমান পানি।

সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, বৃষ্টির পানি নগরের খাল ও নালা দিয়ে নদীতে মিশতে পারছে না। এ কারণে বার বার জলাবদ্ধতা হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close