মো. শাহ আলম, খুলনা

  ০৮ জুন, ২০২৪

চিকিৎসায় অনিয়ম তুঘলকি কাণ্ড

কোথাও প্রশাসনের উদাসীনতা আবার কোথাও পারস্পরিক যোগসাজশে অনিয়ম, এভাবেই চলছে খুলনার দিঘলিয়ার পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে চিকিৎসাবাণিজ্য। কারসাজি ও তুঘলকি কাণ্ড। এ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নেই নিজস্ব কোনো চিকিৎসক। অথচ ক্লিনিকে একাধিক চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে বোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তারের জাল স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট দেন সেখানকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাম ম্যানেজার। এমনকি তিনি নিজেই চিকিৎসক সেজে চিকিৎসা দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সব কাজের কাজি হলেন এস কে নূর মোহাম্মদ।

এদিকে, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলেও শুধুমাত্র ‘সতর্ক’ করার নামে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ, বরং অকারণে করা হচ্ছে সময়ক্ষেপণ।

অন্যদিকে, সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি। অনুমোদন না নিয়েই অবৈধভাবে ক্লিনিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সেই তথ্য নেই খোদ খুলনার সিভিল সার্জন অফিসে। কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অবৈধ ক্লিনিকে সেবার নামে ধোঁকা খাচ্ছে চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়ছে রোগীরা।

অভিযোগ রয়েছে, রোগীদের সিজারিয়ানসহ নানা ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে ক্লিনিকে ভাড়া (অন-কল) করা চিকিৎসক দিয়ে। শুধু অস্ত্রোপচার করিয়ে নিয়ে বাকি কাজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাই করেন। অথচ ক্লিনিকের সামনে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম ব্যবহার করে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে রাখা আছে। যার বেশির ভাগ চিকিৎসক ক্লিনিকে আসে না। তুঘলকি কায়দায় কারসাজি করে ব্যবহার করা হয় এসব ডাক্তারের নাম।

চিকিৎসকের বাবার জিডি : খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা শেরেবাংলা রোড এলাকার বাসিন্দা ডা. শাবনাজ সারোয়ারের পক্ষে তার বাবা মো. গোলাম সরোয়ার বিশ্বাস গত বছরের ৬ ডিসেম্বর দিঘলিয়া খানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, তার কন্যা ডা. শাবনাজ সারোয়ার দিঘলিয়ার পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অস্থায়ী (অন কল) আল্ট্রাসনোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিল। সে ৮ মাস আগে ওই ক্লিনিক থেকে অব্যাহতি নেয়। পরবর্তী সময়ে ৬ এপ্রিল মেয়ে (ডা. শাবনাজ সারোয়ার) এবং স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ওমরা হজের জন্য সৌদি আরব যান। সেখান থেকে ২৯ এপ্রিল দেশে ফেরেন। কিন্তু সৌদি থাকাকালীন ৯ এপ্রিল পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ তার কন্যা ডা. শাবনাজ সারোয়ারের নামে সিলসহ তার স্বাক্ষরিত একটি অন্তঃসত্ত্বা রিপোর্ট তাছলিমা খানম নামক এক রোগীকে দেন। অথচ ওই সময় তার কন্যা সৌদি আরবে অবস্থান করায় উক্ত রিপোর্টটি তিনি দেননি। এ রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী রোগী একটি মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে লোহাগড়া খানা থেকে তার কন্যাকে একটি নোটিস দেওয়ায় সেই রিপোর্টের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন।

চিকিৎসকের অভিযোগ : খুলনার সিভিল সার্জন বরাবর ২৮ এপ্রিল দাখিল করা অপর একটি লিখিত অভিযোগে নগরীর মুজগুন্নি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ডা. ফারজানা খানম উল্লেখ করেন, তিনি চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিকে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় হাসপাতালের মালিক মো. রবির শ্যালক নূর মোহাম্মাদ ভারপ্রাপ্ত মালিক ছিলেন। এ সুবাদে তিনি তার (ডা. ফারজানা খানম) অনুমতি ছাড়াই নাম ব্যবহার করে ও স্বাক্ষর জাল করে একটি ভুল আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট তৈরি করেন। এর আগেও ডা. সাবনাজ সারোয়ার ও ডা. আবদুল্লাহ আল মামুনের নামেও একাধিক আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট তৈরি করেন ক্লিনিক মালিক। এভাবে নাম ও স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ভুল রিপোর্ট তৈরি করায় চিকিৎসক হিসেবে তিনি রোগীর লোকের কাছে হেনস্তার শিকার হন।

অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, ক্লিনিক মালিক নুর মোহাম্মাদ অষ্টম শ্রেণি পাস হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে আল্ট্রাসনোগ্রাম ও প্রেসক্রিপশন করে থাকেন। এ ছাড়া ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হওয়াতে দুজন ডিপ্লোমা নার্স থাকার কথা থাকলেও শুধুমাত্র একজন আছে (রাজিয়া সুলতানা বিথী)। এমনকি ওটি অ্যাসিস্টের কাজ করা বৈশাখীরও কোনো সার্টিফিকেট নেই। কাগজ-কলমে তারা ডাক্তারের কাছ থেকে সাইন নিয়ে থাকে, ডাক্তার ওটি অ্যাসিস্ট করলে বাড়তি টাকা দিতে হবে- তাই নন-মেডিকেল দিয়ে এসব কাজ করিয়ে থাকে। সেখানে অবৈধ উপায়ে সরবরাহ করা সরকারি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এমনকি ডাক্তারকে নরমাল ডেলিভারি করতে দেওয়া হয় না। যার কারণে একটি বাচ্চা মারা যায় এরং আল্ট্রাসনোগ্রাম করে লিঙ্গ বলার জন্য জোর করে। এমতাবস্থায় নিরাপদ মনে না করায় তিনি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এ কারণে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।

এদিকে, উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে সিভিল সার্জনের নির্দেশে বিষয়টি তদন্তের জন্য দাকোপ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালাকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- খুলনা সির্ভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা ও দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আহসান হাবিব।

পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক নুর মোহাম্মাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, এখানে সব ধরনের টেস্ট হয়। খুলনা সির্ভিল সার্জন অনুমোদন না দিলে আমরা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক চালাতে পারি না। আল্ট্রাসনোগ্রাম করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, হঠাৎ একদিন গর্ভবতী একজন রোগী আসছিল, সেদিন ডাক্তার ছিল না- এ কারণে রোগীর হার্টবিট আমি মাপছিলাম। তবে তার হার্টবিট মাপার সঠিক নলেজ নেই বলেও স্বীকার করেন তিনি। ডা. শাবনাজ সারোয়ারের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট করা হয়েছে বলেও স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক নুর মোহাম্মাদ বলেন, তার ক্লিনিকের লাইসেন্স এখনো হাতে পাননি। এ বিষয়ে খুলনা সির্ভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা এ প্রতিবেদককে বলেন, একটা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গত ১৫ মে গিয়েছিলাম। বিষয়টি তদন্তনাধীন।

দিঘলিয়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহাবুব আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, পথের বাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে ডেকে বলে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি চালু থাকলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

খুলনার সিভিল সার্জন শেখ শফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, পথেরবাজার সার্জিক্যাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম করে দিয়েছিলাম। তারা ঘটনাস্থল তদন্ত করে রিপোর্ট আমার কাছে দাখিল করেছেন। যাতে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close