মিজান রহমান
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই চ্যালেঞ্জ
সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ
চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। কারণ চলতি অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বিগত কয়েক মাস ধরে এটা শুধু বাড়তেই আছে। একাধিকবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতি অনুযায়ী নীতি সুদহার ও ঋণের সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মে মাসের ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার আরো বেড়ে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্টের ভিত্তিতে এক বছরের ব্যবধানে ১০০ টাকার খাদ্যপণ্যে দাম বেড়েছে ১০ টাকা ৭৬ পয়সা। বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে বাড়তে বাড়তে মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। তবে যেভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে বাড়ছে না মজুরি। মে মাসে যেখানে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, সেখানে মজুরি সূচকের হার ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছে না আয়। এ অবস্থায় চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার কিছু পলিসি নিয়েছে। এসব বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারের উচিত টাইট পলিসি কন্টিনিউ করা। সরকার ব্যাংকগুলোকে যে লিকুইডিটি সাপোর্ট দিচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে। পলিসি রেট বাড়াতে হবে। মনিটরি পলিসি রেট সাড়ে ৮ আছে, এটা বৃদ্ধি করে সাড়ে ১০ করতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট বাজার অনুযায়ী করতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন। সরকার যদি এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে তবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা অনুযায়ী, বাজেটে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার এ বিশাল ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি, যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ।
এছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। আর দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এবার মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কিমে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (এডিপি বহির্ভূত) ও স্থানান্তরে ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
"