প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৭ মে, ২০২৪

আলোর দূষণে কী কী ক্ষতি হয় মানবদেহে

জাতীয় বিল্ডিং কোডে কী ধরনের আলো ভবনে ব্যবহার করা উচিত, তা নিয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া আছে * বিলবোর্ডের অতি উজ্জ্বল আলোর রশ্মি গাড়িচালকদের মনোসংযোগে বেঘাত ঘটায়

দূষণবিষয়ক আলোচনা শুরু হলেই বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণসহ নানা ধরনের দূষণের নাম উঠে আসে। আলোও যে দূষণ ঘটাতে পারে, তা আলোচনা হয় কম। আমরা কি জানি, আলোর দূষণ আসলে কী? তা কীভাবে মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি করে। শরীরে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটায়। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন নিজেও হয়তো জানতেন না যে, মাত্র ২০০ বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে তার আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক বাতি এতটা সমস্যা তৈরি করবে মানুষের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই ওইসব কারণের দিকে আলোকপাত করে আলোর দূষণ না কমায়, তবে একসময় তা বায়ুদূষণের মতো জটিল আর বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। খবর বিবিসির।

আলোর সঠিক মাত্রা কত? আলোদূষণ, ইংরেজিতে একে বলা হয় লাইট পলিউশন। মানুষ এবং প্রাণিজগতের সব সদস্যের দিনের কর্মযজ্ঞের যে জীবনচক্র, তাতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শরীরের আলো থেকে দূরে বিশ্রাম-ঘুম দরকার। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় এবং বেশি সময় ধরে জ্বলে থাকা আলো অস্বস্তি আর বিরক্তির পাশাপাশি রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে।

সহজভাবে বলতে গেলে, কোথাও যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রার আলো থাকে বা কোথাও যদি অপ্রয়োজনীয় আলো থাকে, তাহলে সেটিকেই আলোদূষণ বলে ব্যাখ্যা করেন বিশেষজ্ঞরা। এই দূষণের জন্য মূলত কৃত্রিম আলো দায়ী।

নিয়ম না মেনে সড়কের যত্রতত্র বাতি স্থাপন, ভবনের ভেতরে ও বাইরের অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, সড়কে ছোট-বড় নানা আকারের বিলবোর্ড বসিয়ে তাতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনসহ নানা কারণে আলোদূষণ হচ্ছে। তবে ঠিক কত মাত্রার আলো হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। কারণ, কোনো স্থানে কতটুকু আলো প্রয়োজন, তা একাধিক নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে। যেমন স্থানের ধরন, আয়তন, গুরুত্ব ইত্যাদি।

বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-তে ভবনে কী ধরনের আলো ব্যবহার করা উচিৎ, তা নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। অ্যাডেক্স লাইটিং সিস্টেম লিমিটেড নামক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারানা আলী বলেন, আলোর ক্ষেত্রে ঘরে কী ধরনের আসবাবপত্র আছে, ঘরটি কোন কাজে ব্যবহার করা হবে, তার আয়তন বা ভবনটি কী দিয়ে তৈরি, ইত্যাদি দেখতে হয়।

ধরা যাক, কোনো অফিসের আয়তন ১০০ বর্গফুট, সেক্ষেত্রে সেখানের অভ্যন্তরীণ আলোর মাত্রা আনুমানিক ৭৪ থেকে ২১০ ওয়াটের মাঝে থাকতে হবে। আবার ভবনের বাইরের আলোর ক্ষেত্রে এটি হওয়া উচিৎ ৪৯ থেকে ৯১ ওয়াটের মাঝে।

২০১৬ সালে করা ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অব আর্টিফিশিয়াল নাইট স্কাই ব্রাইটনেস’ নামে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ মানুষ আকাশ জুড়ে থাকা কৃত্রিম আলোর নিচে বসবাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ৯৯ শতাংশ মানুষ ওই আলোর জন্য রাতের প্রকৃত চিত্র প্রায় দেখতেই পায় না।

২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল, এই ১০ বছরের তথ্য নিয়ে করা ‘নেক্সাস বিটুইন লাইট পলিউশন অ্যান্ড এয়ার টেম্পারেচার : আ স্ট্যাডি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আলোদূষণ বাড়ছে বাংলাদেশে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুল ইসলামের করা সেই গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে সমগ্র বাংলাদেশের মাত্র ৭ দশমিক ১ শতাংশ এলাকায় আলোদূষণ হতো। কিন্তু এক দশক পরে আলোদূষণ বেড়ে হয়েছে ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে শহর এলাকাগুলোয় আলোদূষণ লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু ২০১৩ সালে সেই দূষণ শহরতলি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। গবেষণা অনুযায়ী, আলোদূষণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। ঢাকার পরেই আছে চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, যশোর, রংপুরের নাম।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আলোদূষণের মূল কারণ শহর ও নগরগুলোয় মাত্রারিক্ত বিলবোর্ড। বিলবোর্ডের আলো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয় এবং তাতে বিজ্ঞাপন চলে। এতে যানবাহনের চালকদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। গাড়ি দুর্ঘটনা বাড়ে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুল ইসলামের বক্তব্যও একই। তিনি বলেন, উন্নত যেকোনো দেশে বিলবোর্ডের জন্যও একটা স্ট্যান্ডার্ড লুমেন থাকে, সেই অনুযায়ী তাদের এসব স্থাপন করতে হয়।

‘কিন্তু আমাদের দেশে তো কোনো নিয়ম নেই, আলোদূষণবিষয়ক সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সড়কবাতি বা বিলবোর্ডের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনো কোনো নির্দেশনা নেই।’

তিনি বলেন, বাইরের যে লাইট, তা তো আকাশের দিকেও যায়, সড়কের দিকেও আসে, সেগুলো কীভাবে বসাতে হবে, বিলবোর্ড কেমন হবে, তা নিয়ে কোনো স্ট্যান্ডার্ড ফিক্স করা নাই। অতিরিক্ত আলো মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, লাইট পলিউশন নিয়ে আমাদের দেশে কোনো কথা হয় না। কিন্তু এটা যে কি পরিমাণ স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, আমাদের সে ধারণা নাই।

তিনি বলেন, মানুষের দেহে একটা জৈব ঘড়ি আছে, যা সূর্য ওঠা এবং ডোবার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এই অনাহূত আলোর জন্য সেই মানবঘড়ির কাজে ব্যাঘাত ঘটে।

আর মস্তিষ্ক যখন দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারে না, তখন নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়। যেমন : অতিরিক্ত আলোয় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, ডায়াবেটিসসহ নানা সমস্যা হয়।’

কিন্তু চলাফেরা ও নিরাপত্তার জন্য রাস্তাঘাটে আলো থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে তার প্রভাব কোনোভাবে বসতবাড়িতে পড়তে পারবে না।

বসবাসের জায়গায় উজ্জ্বল আলো দেওয়া যাবে না, তাতে মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়। হাসপাতাল এরিয়াতে দেওয়া যাবে না, তাতে রোগীদের অসুবিধা হয়।

শহরাঞ্চলে গাছপালা কমে যাওয়ায় এমনিতেই পাখিদের আবাসস্থলের পরিমাণ কমছে। এর মাঝে এই বিভিন্ন ধরনের আলোর কারণে তাদের জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার নামের প্রাণী কল্যাণ সংগঠনের চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল বলেন, লাইটের কারণে পাখিদের জন্য রাত নামে না। তিনি মনে করেন, ঢাকায় আগে যে সোডিয়াম লাইট ছিল, তা পাখিদের জন্য অনেক ভালো ছিল। কিন্তু এখনকার এলইডি লাইটগুলো ওদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক।

অতিরিক্ত আলোয় শুধু পাখি না, বিভিন্ন পোকামাকড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় কোনো কোনো বিলবোর্ডের নিচে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন পোকামাকড় মরে পড়ে আছে। অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের ভাষ্য, আলোর উজ্জ্বল কন্ট্রোল করার পাশাপাশি রাত ১০টার পর অপ্রয়োজনীয় বাতি বন্ধ করতে হবে। এ শহরে আলোর মাত্রা কমবে। আলোক দূষণ কমবে।

রাজশাহী শহরের ঝাড়বাতির মতো দেখতে সড়কবাতি নিয়ে পরিবেশবিদদের সমালোচনা দীর্ঘদিনের। কারণ ওই বাতিগুলোয় কোনো শেড নেই এবং বাতিগুলোর আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণের ঘনত্বও বেশি। যা মানবদেহের অতি সূক্ষè মাত্রায় খতি করে। ধীরে ধীরে এই ক্ষতি বেড়ে মানুষের মারাত্মক অসুখ হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close