আরিফ খান, (পাবনা)

  ২০ এপ্রিল, ২০২৪

প্রাণ-প্রকৃতি

পাখিবন্ধু আকাশকলি

আকাশকলি দাসের বয়স এখন ৮৮ বছর। তিনি চিরকুমার। সবার কাছে তিনি ‘পাখিবন্ধু’ বলে পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তার। ঘর-সংসার নেই, ধারে কাছে স্বজন বলতে একমাত্র বোন ঝর্ণা দাস। তিনিও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সেই বোন বিয়ে করেননি। যে বাড়িতে তিনি বাস করেন সেখানে রয়েছে শত শত পাখি।

এসব পাখিই তার স্বজন, পরিবারের সদস্য। পাবনার বেড়া উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে কৈটোলা গ্রামে আকাশকলি দাসের বাড়ি। কাকেশ্বরী নদীর পাশে বাড়িটির আয়তন ছয় বিঘা। জঙ্গলঘেরা বাড়িটির কাছে যেতেই পাখির কলতানে মন ভরে ওঠে যে কারো। বাড়িতে ঢুকলে চোখে পড়ে বিভিন্ন গাছভর্তি পাখি আর পাখি। জঙ্গলে রয়েছে কয়েশ ধরনের গাছ।

আসলে এই বাড়িকে পাখিরা নিরাপদ একটি আশ্রয়কেন্দ্র মনে করে। আর করবে না-ই বা কেন? কারণ সেখানে ঢুকে তাদের ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই। এ ছাড়া রয়েছে খাবারেরও নিশ্চয়তা। বাড়ির মালিক আকাশকলি দাস দিন-রাত তাদের পাহারা দেন। প্রতিদিন তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দেন। পাখিদের প্রতি তার এমন ভালোবাসা দেখে গ্রামের মানুষের কাছে তিনি ‘পাখিবন্ধু’ নামে পরিচিত। তাকে দেখে গ্রামবাসীও পাখিদের ভালোবাসতে শিখেছেন। তাই কোনো পাখি শিকারি বাড়ির ধারে-কাছে এলে এখন আর আকাশকলি নন, গ্রামবাসীই তাদের প্রতিহত করে। অবশ্য বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় কোনো পাখি শিকারি এখন আর ওই বাড়িমুখো হয় না। বাড়ির গাছগুলোয় শত শত পাখির আনাগোনা দেখে মৎস্য অধিদপ্তরের ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (ডব্লিউবিআরপি) ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাড়িকে ‘পাখির অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করেছে। কাছে-দূরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা পাখি দেখতে নিয়মিত ভিড় জমান সেখানে। বিশেষ করে অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে গোটা শীত মৌসুমে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ এ সময় সেখানে দেশি পাখির সঙ্গে অতিথি পাখিরাও আশ্রয় নেয়।

যেভাবে পাখিবন্ধু : আকাশকলি জানান, শুধু পাখি নয় যেকোনো প্রাণীর প্রতি তার ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলা থেকেই তার নেশা ছিল রাস্তা থেকে বিপদে পড়া কুকুর, বিড়াল বাড়িতে নিয়ে এসে আশ্রয় দেওয়া। এ জন্য ১০ থেকে ১৫টি করে কুকুর ও বিড়াল সব সময় থাকে তার বাড়িতে। পৈতৃক সূত্রে তিনি ছয় বিঘা আয়তনের যে বাড়িটি পেয়েছেন তার বেশির ভাগই জঙ্গলে ভরা। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় সব গাছ। সেই সব গাছে পাখিদের ভিড় লেগেই থাকত।

৪৫ থেকে ৫০ বছর আগে আকাশকলি লক্ষ করেন বাড়ির গাছে দেশি-বিদেশি পাখিদের ভিড় বেড়েই চলেছে। বিষয়টি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে তার বাড়ির পাখিদের প্রতি লোভের দৃষ্টি পড়ে পাখি শিকারিদের। বিষয়টি বুঝতে পেরে শিকারিদের তাড়ানোর জন্য পাহারা দেওয়া শুরু করেন তিনি। তার কঠোর অবস্থানের কারণে শিকারিরা এক পর্যায়ে সেখান থেকে পাখি শিকারের হাল ছেড়ে দেয়।

এরপর তিনি পাখিদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থাও শুরু করেন। গাছের নিচে বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে কলাগাছের পাতা পেতে ভাত রেধে পাখিদের জন্য রাখতে শুরু করেন। পাখিরাও তার দেওয়া খাবার খেতে থাকে। এভাবে নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পেয়ে পাখিদের সংখ্যা সেখানে দিন দিন বাড়তেই থাকে। আকাশকলি এখনো পাখিদের প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। আকাশকলি বলেন, ‘পাখিদের না খাইয়ে খেতে ইচ্ছা করে না। ওরা আমার সন্তানের মতো। আসলে ওরা ভালোবাসা বোঝে। তাই আমার বাড়িতে এসেই ওরা ভিড় করে।’

পাখিবন্ধুর পাখিরা : আকাশকলি জানান, সারা বছরই তার বাড়িতে পাখিদের ভিড় থাকে। তবে শীত মৌসুমে এই ভিড় ব্যাপক বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দেশি বক, কানি বক, পানকৌড়ি, শামুকখোল, ঘুঘু, দোয়েল, শালিক। এ ছাড়া শীত প্রধান অঞ্চল থেকে আসা পরিযায়ী পাখির মধ্যে ছোট সরালি, বড় সরালি, খঞ্জনা, পাতিহাঁস প্রজাতির পাখিও দেখা যায়। এসব পাখি স্বাচ্ছন্দ্যে গাছে বিচরণ করে। ঝাঁকে ঝাঁকে ডানা মেলে নির্ভাবনায় উড়ে বেড়ায় ইচ্ছামতো।

অভয়াশ্রম যেভাবে : আকাশকলির বাড়িতে পাখিদের ব্যাপক ভিড়ের কথা ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে আরো বিভিন্ন এলাকায়। পাখি দেখতে দিনকে দিন বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। পাখির এমন নিরাপদ আবাসস্থলের বিষয়টি নিয়ে পরিবেশবাদী বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) আইইউসিএন কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়। তাদের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মৎস্য অধিদপ্তরের ওয়েটল্যান্ড বায়োডাইভারসিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (ডব্লিউবিআরপি) বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে। তবে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হলেও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ সেখানে বিশেষ কোনো সহযোগিতা ও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

যেভাবে চলছে তার জীবন : আকাশকলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। পৈতৃক সূত্রে সাড়ে ছয় বিঘা আয়তনের বাড়িটি ছাড়াও পেয়েছেন কৃষিজমি। বাড়ির একদিকে রয়েছে একটি গরুর খামার। ৮৮ বছর বয়স তার, অথচ বিয়ে করেননি। আত্মীয়-স্বজন বলতে একমাত্র বোন ঝর্ণা দাস (৭০) ছাড়া তেমন আর কেউ নেই। বিশাল বাড়িতে বোনের সঙ্গেই থাকেন তিনি। আত্মীয়-স্বজন সবাই ভারতে চলে গেছেন। রাখাল আর কাজের লোক দিয়ে খামার ও কৃষিজমি দেখাশোনা করেন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই তার কাটে বাড়ির পাখিদের পরিচর্যায়। তবে বয়সের বারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় আগের মতো তেমন কিছুই আর করতে পারেন না।

এলাকার লোকজন মনে করেন, পাখিদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার টানেই অকৃতদার রয়ে গেছেন তিনি। তবে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে মৃদু হেসে তিনি বলেন, ‘পাখিদের সন্তানদের মতো ভালোবাসি। তবে কেন বিয়ে করিনি সেটা আমি নিজেও জানি না।’

সরেজমিনে এক দিন : আকাশকলির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গছে কাগেশ্বরী নদী। বাড়ির পাশেই নদীপারে আবদুল ওয়াদুদের চায়ের দোকান। সেখানে চা পান করতে করতে আড্ডা দিচ্ছিলের কৈটোলা ও পাঁচুরিয়া গ্রামের ১০ থেকে ১৫ জন। আকাশকলির প্রসঙ্গে কথা তুলতেই সবাই তার প্রতি সমীহ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। সবার এক কথা- পাখিদের প্রতি এমন ভালোবাসা সত্যিই বিরল।

কৈটোলা গ্রামের ওমর আলী ও কালু সরদার বলেন, তার (আকাশকলি) বাড়িটি এখন এই গ্রামের গর্ব। বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে পাখি দেখতে আসে। পাখির কিচিরমিচির ও কলকাকলিতে গ্রামের সবাই মুগ্ধ হয়ে থাকে। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা শেষ করে আকাশকলির বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই হাজারো পাখির ডাক কানে আসে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ভাঙাচোরা ছাপড়া ঘরে তিনি বাস করেন। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি স্নেহে পাখিদের দেখছিলেন। সেখান থেকেই দেখা যায় প্রতিটি গাছেই রয়েছে অসংখ্য পাখি। আর গাছের নিচের বিস্তৃত অংশ একেবারে সাদা হয়ে রয়েছে। আকাশকলির সঙ্গে কথা বলে জানা যায় পাখির বিষ্ঠায় এমন সাদা হয়ে আছে। এরই এক পাশে দেখা যায় পাঁচণ্ডছয়টি কলাপাতা পেতে রাখা হয়েছে। একটু পরেই সেখানে পাখিদের খাবারের জন্য ভাত দেওয়া হবে। ওই বাড়িতে অবস্থানকালে বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীকেও আসতে দেখা যায়।

তার আক্ষেপ : গত চার-পাঁচ বছর হলো পাখি শিকার ব্যাপক বেড়ে গেছে বলে আক্ষেপ করেন আকাশকলি। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে পাখিগুলো নিরাপদে থাকে। কাউকে ছুঁতেও দেই না। কিন্তু খাবারের সন্ধানে ওরা বিল বা চরাঞ্চলে গিয়ে আর ফিরে আসে না। আর এভাবেই দিনকে দিন পাখির সংখ্যা কমছে।’

তাদের কথা : মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি সময় পেলেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তার বাড়িতে পাখি দেখতে যাই। তিনি শুধু পাখিদের রক্ষা করছেন না পরিবেশকেও বাঁচিয়ে রাখছেন। তার মতো আরো কিছু মানুষ থাকলে আমাদের পরিবেশ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচত।’ বেড়া উপজেলা বন কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি তার অভয়াশ্রমে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছি। তার অভয়াশ্রমে সহায়তা করার জন্য আমার সব সময় নজর থাকবে। অভয়াশ্রমের বাইরেও কেউ যাতে পাখি শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে আমি সব সময় খেয়াল রাখছি।’

বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোরশেদুল ইসলাম জানান, ‘আমি কিছুদিন হলো এ উপজেলায় যোগদান করেছি তার বিষয়ে শুধু লোকমুখে জেনেছি। আমি সময় করে তার বাড়িতে যাব। তার বিষয়ে খোঁজখবর নেব। সে যদি উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চায় অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close