আল-আমিন মিয়া, নরসিংদী

  ০৪ এপ্রিল, ২০২৪

পলাশের ডাঙ্গা ইউনিয়ন

বালু ফেলে তিন ফসলি জমি দখল, দেখার কেউ নেই

প্রতিবাদ করতে গিয়ে কৃষকরা হামলা ও হুমকির শিকার * রয়েছে দেড় শতাধিক গুণ্ডার বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী * নিজের জমি হারিয়ে আত্মাহুতির হুমকি কৃষক আবদুল হাইয়ের

নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলামপাড়া এবং কাজীরচর গ্রামে কৃষকদের কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার তিন ফসলি জমি দখল করে বালু ভরাটের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে। তার নাম খোরশেদ হোসেন সেলিম। এই জমির পরিমাণ শতাধিক একর হবে বলে জানা গেছে। কৃষিজমি নষ্ট না করার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ রয়েছে। অথচ এই জমি গায়ের জোরে গ্রাস করছে ভূমি দস্যুরা। কৃষকরা বলেছেন, তারা অসহায়, তাদের অধিকার দেখার জন্য কেউ নেই। স্থানীয় প্রশাসনও কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

খোরশেদ হোসেন সেলিম ডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাবের উল হাইয়ের ছত্রছায়ায় এসব তিন ফসলি কৃষজমি দখল করে বালু ভরাট করা হচ্ছে। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমি দখল চক্রের সদস্যদের হাতে হামলা ও হুমকির শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা।

এসব নিয়ে কৃষকদের পক্ষ থেকে গত বছরের ৫ নভেম্বর নরসিংদী জেলা প্রশাসক এবং ২ নভেম্বর পলাশ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে কৃষক মো. রতন মিয়া ১০১ জনের গণস্বাক্ষরযুক্ত লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও ৪ মাসেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। বরং জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছেন বলে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন কৃষকরা। নিজেদের জমি দখলে রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আত্মাহুতির হুমকি দিয়েছেন আবদুল হাই নামে এক কৃষক।

স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন বলছে, অবৈধভাবে দখল করে কৃষিজমিতে বালু ভরাটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তারা। বালু ভরাট বন্ধ করে দেওয়াসহ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানাও আদায় করা হচ্ছে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া কৃষকদের পক্ষ থেকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী জেলা জজ আদালতে অভিযুক্ত এ যুবলীগ নেতা খোরশেদ হোসেন সেলিম ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাবের উল হাইসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন মো. সাইফুল ইসলাম নামে এক কৃষক। সরেজমিন গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত চার মাস ধরে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবের উল হাইয়ের মদদে ডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে ডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য কৌশিক আহমেদ নয়ন, আওয়ামী লীগ নেতা তাজুল ইসলাম, ফয়েজ মিয়া ও কাজলসহ দেড়শতাধিক লোক নিয়ে গঠিত সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে কৃষকের জমি দখল শুরু করে । দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পেতে তখন থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ভুক্তভোগীরা। জানা গেছে, জমি হারিয়ে দিশেহারা কৃষকরা। জমি দখলকারীরা সবাই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাবের উল হাইয়ের লোক বলে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, পলাশ উপজেলার ডাঙ্গায় ইসলামপাড়া ও কাজীরচর গ্রামে রয়েছে বিশালাকৃতির একটি তিন ফসলি মাঠ। যেখানে কৃষকরা ধান, কলা, বেগুন, পাট, সরিষাসহ পর্যায়ক্রমে একই জমিতে তিনটি ফসল উৎপাদন করতেন। এমন ফসলি জমির রোপণ করা ফসল নষ্ট করে অবৈধভাবে জমিগুলো দখল করে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এতে কৃষি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় ধরনের হুমকি হতে পারে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ। অন্যদিকে কৃষকদের অভিযোগ, এরই মধ্যে ২৫০ বিঘা তিন ফসলি জমি বালি ভরাট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এই মাঠের তিনটি সেচপাম্পও জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে বালু ভরাটের প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের ওপর একাধিকবার হামলা করা হয়। হামলা করে কৃষকদের কয়েক দফায় মারধরও করা হয়। একাধিকবার হামলা চালিয়ে নারী-পুরুষসহ বেশ কয়েক জনকে গুরুতর আহতও করা হয়। এছাড়া প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ায় অনেকেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে করে ওই এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভুক্তভোগী কৃষক রতন মিয়া জানান, ডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাবের উল হাইয়ের সমর্থন পেয়ে ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে তাদের একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে কৃষকের অনুমতি ছাড়াই দিনের পর দিন অবাধে বালি দিয়ে কৃষিজমি ভরাট করে দখল করছে। কেউ জমিতে নামতে গেলেই তাকে মারধর করা হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। এ ছাড়া কৃষকরা তাদের নিজ জমিতে নামলে তাদের ওপর হামলা করার অভিযোগ করেন কৃষকরা।

পলাশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার জানান, পলাশের ডাঙ্গা এলাকার তিন ফসলির জন্য সব থেকে বড় মাঠ এটি। আর এ মাঠ ভরাট হয়ে গেলে কৃষি উৎপাদনে সমস্যা হবে। তাই মাঠে বালু ভরাট বন্ধ করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। যুবলীগ নেতা খোরশেদ হোসেন সেলিমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিন আগে ওই যুবলীগ নেতা সেলিম ওমরা পালনের জন্য সৌদি আরব গিয়েছেন। এদিকে ডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবের উল হাই বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাই আমার নাম জড়ানো হয়েছে এখানে। তিনি এসবের কিছুতেই জড়িত নন দাবি করে আরো বলেন, কৃষকদের কৃষিজমি জোরপূর্বক দখল করেছে এমন কোনো অভিযোগ কেউ আমাকে দেয়নি। তবে শুনেছি, প্রাণ গ্রুপ এখানে কিছু জমি কিনেছে। আর ওই জমিতে বালু ভরাটের কাজ পেয়েছেন সেলিম। এখানে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করেন ওই চেয়ারম্যান।

এসব বিষয়ে পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, কৃষিজমিতে অবৈধভাবে বালু ভরাট-দখলের বিরুদ্ধে আমরা শক্ত অবস্থানে রয়েছি। এরই মধ্যে ওইসব কৃষিজমিতে বালু ভরাট বন্ধ করাসহ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close