নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০২ এপ্রিল, ২০২৪

সৌদি প্রবাসীদের লুকোচুরি জীবন

সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিন দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশি শ্রমিকরা। এর মধ্যে সৌদি আরবে যান অনেক বেকার যুবক-যুবতি। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। এক কাজের জন্য বলা হলেও অন্য কাজ করা হয়। এছাড়া থাকাণ্ডখাওয়া নিয়েও দুর্ভোগে পড়তে হয় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের। লাখ লাখ টাকা খরচ করেও অনিশ্চয়তার জীবন শুরু হয় শ্রমিকদের। সৌদি প্রশাসনের ভয়ে সেখানে লুকোচুরি করে জীবন পার করতে হয় অনেক শ্রমিকের। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার পাংখারচর গ্রামের এক যুবক সংসারে সচ্ছলতা আনতে ২০২২ সালে সৌদি আরবে যান। রোমান শেখ নামে এক দালালের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরব যান। ওই দালাল একই এলাকার লোক, এ কাজের জন্য নিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী সৌদিতে নেওয়ার পর যুবক মনিরুলকে ভালো কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং থাকাণ্ডখাওয়ার সুব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা ছিল দালালের। একই উপজেলার আরো চারজনকে নির্ভরযোগ্য কাজের কথা বলে সৌদিতে নিয়েছেন রোমান শেখ। কিন্তু তিনি তাদের ‘উপহার’ দিয়েছেন অনিশ্চয়তার এক জীবন। সৌদিতে যাওয়ার পর এই পাঁচজনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এক বছর ধরে ওই পাঁচ যুবক সৌদি আরবে আতঙ্কে দিন পার করছেন। তাদের মতোই অনেক প্রবাসী আতঙ্কে রয়েছেন। যাদের জীবন কাটছে সৌদি প্রশাসনের সঙ্গে লুকোচুরি করে।

এ কারণে কয়েক বছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে কম। অভিবাসন গবেষণা সংস্থা (রামরু) গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রতি মাসে যত কর্মী সৌদি আরবে যান, তার ১৪ শতাংশ ওই মাসেই ফেরত আসে। এ ছাড়া সৌদিতে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে যাওয়ার প্রথম তিন মাসের মধ্যে ফেরত আসে ১৩ শতাংশ, ছয় মাসের মধ্যে ২৪ শতাংশ এবং এক বছরের মধ্যে ৪৯ শতাংশ।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ২৬ দেশের কারাগারে বাংলাদেশের ৯ হাজার ৩৭০ শ্রমিক ও প্রবাসী আটক রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি আটক রয়েছেন সৌদি আরবে ৫ হাজার ৭৪৬ জন।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ৪৯ হাজার ২৬২ জন। গত বছর গেছেন ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন। ২০২২ সালে ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ ও ২০২১ সালে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ এবং ২০২০ সালে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জন। চলতি বছরসহ চার বছরে সৌদিতে গেছেন ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩০৭ জন শ্রমিক। সৌদি আরবে এখন বাংলাদেশের শ্রমিকদের অনেকেই দুঃসহ জীবন পার করছে। এর মূলে রয়েছে দালালরা। তাদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব অনেক প্রবাসী শ্রমিক। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক নতুন করে প্রবাসীর তালিকায় যুক্ত হলেও সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর জন্য দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং দালালের খপ্পরে পড়ে কাজ না পেয়ে বেকার থাকাকে দায়ী করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫৪ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ৩৭৬ কোটি ডলারে নেমে আসে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪২ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯০ কোটি ডলারের বেশি।

সৌদির জিজান শহরের একটি বাড়িতে বন্দি থাকা প্রবাসী দিশান বলেন, ‘দালালের খপ্পরে পড়ে সৌদিতে এসে এখন আমি বন্দিজীবন পার করছি। এক বছর ধরে আমি দিনে বের হতে পারি না। বের হলেই পুলিশ গ্রেপ্তার করবে। রাত হলে জীবন চালানোর জন্য লুকিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। তাতেও গ্রেপ্তারের আতঙ্ক। আমাদের সঙ্গে আসা একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আরো অনেক বাংলাদেশি গ্রেপ্তারের আতঙ্কে রয়েছে। এখন বাড়ি থেকে টাকা এনে আউটপাস সংগ্রহ করে দেশে ফেরার চেষ্টা করছি। বাড়িতে টাকা পাঠানোর বদলে উল্টো ঋণ করে দেশে ফিরতে হচ্ছে।’

সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে চলতি মাসের এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার ৪০ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রেপ্তারের ঘটনা। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, আবাসন আইন লঙ্ঘনের দায়ে ১২ হাজার ৯৫১, সীমান্ত সুরক্ষা আইনে ৬ হাজার ৫৯২ এবং শ্রম আইনের আওতায় ৩ হাজার ৪৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর বসবাসের অনুমতিহীনতা এবং শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের দায়ে ৪ হাজার ৬৯০ জন নারীসহ ৫৯ হাজার ৭২১ জনের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। গ্রেপ্তার প্রবাসীদের মধ্যে ৫২ হাজার ৮১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর আগে ভ্রমণের প্রয়োজনীয় নথি জোগাড়ের জন্য কূটনৈতিক মিশনে পাঠানো হয়েছে। আরো ১ হাজার ৯৬৩ জনকে সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ৯ হাজার ১৭৯ জনকে সৌদি আরব থেকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘এখন প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ৩০০ জন আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরছেন। তাদের মধ্যে অনেক সৌদিপ্রবাসীও আছেন। সম্প্রতি ওই দেশে আকামার মেয়াদ শেষ হওয়া শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। তবে সৌদি থেকে কতজন ফিরেছেন, এ রকম তথ্য আমাদের কাছে নেই।’

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও অভিবাসী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সজীব বালা বলেন, ‘সম্প্রতি সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক বেশি প্রতারিত হচ্ছেন। ওই দুই দেশের কর্তৃপক্ষ অবৈধ প্রবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে। অনেক অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিও আটক হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা দুঃখজনক।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close