খলিলুর রহমান, ভালুকা (ময়মনসিংহ)

  ০২ মার্চ, ২০২৪

সেদিন কী ঘটেছিল গ্রীণ অরণ্য পার্কে

‘আকস্মিক সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল। একজন ব্যক্তি তাকে বাঁচানোর আকুতি করছেন। কয়েকজন যুবক তাকে ধমকাচ্ছেন। মুহূর্তের মধ্যেই হইচই পড়ে যায় নেটদুনিয়ায়। শুরু হয় নিন্দার ঝড়। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ইচ্ছেমাফিক মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থল থেকে কিছু মন্তব্য ও কয়েকটি পোস্টে মন্তব্য আসে ফেসবুকে। মুহূর্তেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট।’ ঘটনাটি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের ‘গ্রীণ অরণ্য পার্ক’-এর। প্রতিদিনের সংবাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে শুরু হয় অনুসন্ধান। জানার চেষ্টা করা হয়- কী ঘটেছিল সেদিন গ্রীণ অরণ্য পার্কে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ঘটনার দিন মো. শাজাহান মিয়া তার পরিবার নিয়ে গ্রীণ অরণ্য পার্কে বেড়াতে জান। শাজাহান মিয়া সুইং চেয়ার রাইড টি ব্যবহারের জন্য টিকিট সংগ্রহ করেন। সুইং চেয়ার ব্যবহারকে কেন্দ্র করে পার্কের কর্তব্যরত স্টাফদের সঙ্গে শাজাহান খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। এতে উভয়ের মধ্যে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। কৌশলে শাজাহান মিয়া ঘটনাটি ভিডিও করেন এবং ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। বিষয়টি গড়ায় থানা পুলিশ পর্যন্ত। উভয় পক্ষ থেকে থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগও করা হয়। অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পুলিশ। আমরা তুলে ধরতে চাই একটি ভিডিও, ভাইরাল হওয়ার পেছনে কারা কাজ করেছেন, কেন করেছেন।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, ১৯৯০-এর দশকে ভালুকার পাশর্^বর্তী উপজেলায় কয়েকটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠলেও ভালুকায় কোনো বিনোদন কেন্দ্র ছিল না। একই সময়ে ভালুকায় গড়ে উঠে বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিভিন্ন অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ এই এলাকায় বসবাস শুরু করে। ফলে ভালুকা তথা হবিররাড়ী হয়ে উঠে একটি গণবসতিপূর্ণ অঞ্চল। কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষের একটু বিনোদন দরকার। কিন্তু সপ্তাহের একটি দিন এসব কর্মজীবী মানুষের বেড়ানোর যাওয়ার জায়গা নেই। আবার দূরে কোথায় বেড়াতে যাওয়ার আর্থিক সামর্থও নেই অনেকের।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মজীবী সাধারণ মানুষের স্বল্পব্যয়ে তাদের বিনোদনের কথা চিন্তা করে স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা শহীদুল ইসলাম এগিয়ে আসেন, উদ্যোগ নেন একটি নির্মল বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলার। যেখানে সব শ্রেণি পেশার মানুষের বিনোদনের সুব্যবস্থা থাকবে। পাশর্^বর্তী এলাকায় কয়েকটি বিনোদন কেন্দ্র থাকলেও সেগুলো নামে মাত্র বিনোদন কেন্দ্র। প্রকৃত অর্থে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা ফ্যামিলি ডে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য স্থান নির্ধারণ ও বুকিং দিতে গিয়ে যখন প্রাথমিকভাবে পরিদর্শনে যান, তখন গ্রীণ অরণ্য পার্ককেই তারা বেছে নেন। ফলে গ্রীণ অরণ্য পার্কটি ক্রমেই বিনোদনপ্রিয় দর্শক ও পর্যটকের আস্থা ও পছন্দের যায়গায় পরিণত হয়। এতে ঈর্ষান্নিত হয়ে উঠেন অনেকেই। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি যখন তাদেরই কারো নজরে আসে, তখন তারা বিষয়টি লুফে নেন। অপপ্রচারে নেমে পড়েন। যদিও শেষ পর্যন্ত অপপ্রচার ধুপে টেকেনি।

কী আছে গ্রীণ অরণ্য পার্কে : ময়মনসিংহের প্রবেশমুখে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ীতে শালগজারী বনের ভেতর চারদিকে মনোমুগ্ধকর সবুজ প্রকৃতির মাঝখানে গড়ে তোলা হয়েছে গ্রীণ অরণ্য পার্কটি। নিরাপদ প্রাচীরে ঘেরা অবকাশযাপন ও সম্পূর্ণ পারিবারিক বিনোদনের জন্য এরই মধ্যে পার্কটি সাধারণ দর্শনার্থী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাদেরও নজর কেড়েছে। জানা যায়, জাপানের একটি পার্কের আদলে পার্কটি নির্মাণ করা হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ, দর্শনার্থীদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও বাথরুমসহ বিশ্রামাগার সবকিছুই করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে। বনভোজন থেকে শুরু করে বড় অনুষ্ঠান করার মতো জায়গা রয়েছে পার্কটিতে। পার্কটি সবুজে ঘেরা। শহরের কোলাহলমুক্ত। পার্ক তথা পার্কের আশপাশে অশ্লীলতা ও মাদকমুক্ত পরিবেশ, পরিবার নিয়ে নির্মল বিনোদনের জন্য অনন্য। এককথায় অন্য যেকোনো পার্কের চেয়ে নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশ এখানে রয়েছে। এই পার্কটি এরই মধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আস্থার স্থানে পরিণত হয়েছে। সবুজ অরণ্য, টেক-টিলা আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এমন বিনোদন রিসোর্ট সাধারণত আশপাশ এলাকায় পাওয়া যায় না। ছুটির দিনে হাজারো দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে পার্কটি। রাস্তার দুই পাশ সাজানো হয়েছে নানা দেশি-বিদেশি গাছে। উঁচুনিচু টেক টিলায় ঝুলন্ত ব্রিজ, পাশাপাশি দূরত্বে লেকের ধারে মনোরম পরিবেশে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কটেজ, লেকের স্বচ্ছ পানি আর সুইমিং পুল। লেকের ধারে রয়েছে একটি হলরুম যেখানে বিয়ে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানের সুব্যবস্থা রয়েছে।

শিশুদের জন্য রয়েছে একটি ছোট চিড়িয়াখানা। হরিণ, ঘোড়া, ময়ূূর, ময়না পাখিসহ বিভিন্ন পশুপাখি বিনোদনের মনোযোগ আকৃষ্ট করছে। পার্কের সঙ্গেই লেকের ব্যবস্থা করা আছে, যেখানে তৃষ্ণার্ত বন্য বানরের দল বিভিন্ন সময় পানি পান করে।

বিশেষ আকর্ষণ : পড়ন্ত বিকেলে চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক, কানি বক ও নানা জাতের পাখি পার্কের গাছে বসতে শুরু করে রাতযাপনের জন্য। প্রকৃতির এমন অপার সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি শনিবার ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রীণ অরণ্য পার্কে পিকনিক হয়। এতে বিভাগীয় কমিশনারসহ ময়মনসিংহ বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও ফ্যামিলি ডে পালন করা হয় গ্রীণ অরণ্য পার্কেই।

স্থানীয় বাসিন্দা আফতাব উদ্দিন (আতা ঢালী) জানান, এই অঞ্চলের শিল্প কারখানার কর্মরত স্বল্পআয়ের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ আমাদের যখন বিনোদনের কোনো জায়গা ছিল না তখন হাজি শহীদুল ইসলাম গ্রীণ অরণ্য পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। দীর্ঘ সময় পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন এই পার্ক। এই পার্কে স্থানীয়দের পাশাপাশি এই অঞ্চলের মিল কারখানায় কর্মরত কর্মজীবী সাধারণ মানুষ স্বল্প ব্যয়ে নির্মল বিনোদনের একটি বিশাল সুযোগ পেয়েছেন।

জামিরদিয়া আবদুল গণি মাস্টার স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম লিটন বলেন, গ্রীণ অরণ্য পার্ক অ্যান্ড রিসোর্টটি এখন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য পছন্দের স্থানে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিয়ে বিনোদনের জন্য গ্রীণ অরণ্য পার্কে আসে। এটি ভালুকার সম্পদ, দেশের গর্ব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close