হামিম কামাল, কথাসাহিত্যিক
লেখকের কথা
বুকে আগুন আছে তোমাদের?
‘বইমেলা আসছে না? দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এ হলো মেলার আগে আমাদের সাধারণ বাক্য। হয়তো নিছক কল্পনা। মেলা এলে সত্যিই কি সব ঠিক হয়ে যায়? ১১ মাসজুড়ে বুকে যে ব্যথা জমে, তা কি এক মাসে দূর হয়, না ভুলে থাকা যায়? আর যে ব্যথা ৮ বছর ১১ মাসজুড়ে বাজছে, বাজবে আজীবন, তা কি একুশে গ্রন্থমেলা দূর করতে পারে? নাকি বারংবার মনে করিয়ে দেয়?
বিষণ্ণতার কথা বলছি বলেই, বিষণ্ণতা পুষছি এমন না। শক্তির কথাও বলি। পৃথিবী তো সবকিছুকেই টানছে নিজের দিকে। এই মহাশক্তির নাম অভিকর্ষ। সেই টানের বিরুদ্ধে নিয়ে, কোনো বস্তুকে যদি একটু ওপরে বা দূরে রেখে দিই, তাতে বিভবশক্তি জমা হয়। আমাদের বিবেক আছে। বিবেকের ভেতর কি এক ধরনের অভিকর্ষ আছে? সময়, বিবেক থেকে আমাদের যত দূরে নিয়ে যেতে থাকে, আমাদের ভেতর তত বিভব জমতে থাকে, আর আমরা বিবেকের দিকে ছুটে যাওয়ার তত তীব্র আগাদা অনুভব করতে থাকি। সেই তাগাদার একটা দৃশ্যমান রূপ গ্রন্থ।
হ্যাঁ, এটাও শুনেছি বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেই, এমন কথা গ্রন্থ দেয় না। সব গ্রন্থ এক নয়। যে কারণে, সব গ্রন্থ সবার নয়। গ্রন্থেরও শুভণ্ডঅশুভ আছে। নিজ বিশ্বাসের বাইরের গ্রন্থকে অশুভণ্ডঅশুভ লাগে, তাই গ্রন্থের শুভাশুভ নিয়ে বিবাদ চলবেই। আমি এখানে শুধু বিবেকের অনুবর্তী গ্রন্থকে শুভগ্রন্থ মেনে কথা বলছি।
একুশে গ্রন্থমেলা যখন বছর ঘুরে আসে, শুভ গ্রন্থগুলো বিরাট মাঠজুড়ে একত্রিত হয়, তখন একটা পবিত্র আলোর জাগে। এ আলোর জন্ম কোথায়?
আমার প্রিয় লেখকদের একজন করম্যাক ম্যাকার্থি। তার ‘দ্য রোড’ বইয়ে বিশেষ এক মুহূর্তে এক আগুনের কথা আছে। উপন্যাসের ছোট্ট ছেলেটা নতুন মানুষটার কাছে জানতে চায়, ‘আর ইউ ক্যারিং দ্য ফায়ার?’
দ্য রোড-এ এক নরকরাজ্যের গল্প বলা হয়েছে যেখানে মানুষের খাদ্য মানুষ। এক বাবা তার ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জীবন থাকতে ছেলেকে খাদ্যে পরিণত হতে দেবে না। ছোট্ট ছেলেটা যাকে প্রশ্ন করে, সেই নতুন মানুষটা, বুঝতে পারে না ছেলেটা কোন আগুনের কথা বলছে। সে বলে, ‘অ্যাম আই হোয়াট?’ ছেলেটা একটু নিষ্প্রভ হয়ে আসে, বলে, ‘ক্যারিং দ্য ফায়ার।’ ছেলেটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও মনে পড়ে, তার প্রতি বাবার শেষ কটা কথা। বাবা ব্যগ্র হয়ে বলছিলেন, আমার মৃত্যুর পর তুমি তেমন মানুষ খুঁজে বের করো যার বুকে সেই আগুন আছে।
যে আগুনের পরশমণি আমাদের সাহিত্যরবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাণে ছুঁইয়ের দেওয়ার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন দেবতার কাছে, যে আগুনের কথা লিখে গেছেন ম্যাকার্থি, সেই আগুনের আলোয় ভোর হয়ে আছে একুশে গ্রন্থমেলা।
তবু ব্যথা বাজে। একদিন, এই মেলাফেরত একজন মানুষের রক্তাপ্লুত জীবনাবসান ঘটেছিল মেলার প্রাঙ্গণে। অভিজিৎ রায়ের কথা ভুলি কী করে? একুশে গ্রন্থমেলা এলেই মনে পড়ে যায়। তাকে হত্যা করতে এসেছিল এমন কিছু মানুষ, যাদের বুকের আগুন নিভে গেছে। সেই আগুন নিভে গেলে কেউ হত্যাকারী হয়।
প্রার্থনা করি প্রকৃতির কাছে, মেলা থেকে পরশমণি-আগুন নিয়ে ফেরার কালে আর কখনো কাউকে যেন অভিজিৎ রায় হতে না হয়।
আমি কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারের দাবি আর জানাব না। আমি বরং প্রকৃতির কাছে বলব, হে প্রাজ্ঞ প্রকৃতি, তুমি তো জানো যারা হত্যা করে, তাদেরও হৃৎপিণ্ড আছে। বেঁচে থাকাই হোক তাদের জ্যান্ত কারাবাস, বেঁচে থাকাই হোক তাদের অক্ষয় ফাঁসিকাঠ।
আমি এখনো বিশ্বাস করি, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।’ একদিন তাদের মনেও সেই আগুন জ্বলে উঠুক; যে আগুন নিভে গেছে অনেক দিন আগে। সেই আগুনে তাদের হত্যাকারী সত্ত্বার যেন চিরমৃত্যু হয়। বইমেলা এসেছে। সব ঠিক হয়ে যাক।
"