রকি উল হাসান, কুবি

  ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

শিক্ষকের পদোন্নতির কঠিন শর্তে কুবিতে অসন্তোষ

পদোন্নতির ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষকরা উপাচার্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। অসন্তুষ্ট শিক্ষকদের অভিযোগ নীতিমালার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে বেকায়দায় ফেলা হচ্ছে তাদের। তবে উপাচার্য বলছেন এসবে তার হাতে নেই, সবই নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের মান উন্নতির জন্য নীতিমালার বাইরে অতিরিক্ত গবেষণার শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও গবেষণার পাশাপাশি এককভাবে উঁচু মানের জার্নালে প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশের অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। কখনো কখনো দেখা যায় সিনিয়র শিক্ষকদের আগে জুনিয়র শিক্ষকরা প্রমোশন পেয়ে যাচ্ছেন এতে বিভাগগুলোয় সিনিয়র জুনিয়রিটি মানা হচ্ছে না। তা ছাড়া আগে পদন্নোতির ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত শর্তগুলো ছিল না এখন এই অতিরিক্ত শর্তগুলো দেওয়া হচ্ছে।

এই ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, ‘এটা আসলে নির্ভর করে সে সিনিয়র থাকতে চায় কি না। একজন শিক্ষক যদি প্রিডেটরি জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করে বা গবেষণা না করে তাহলে তার পদন্নোতি হবে না। একজন জুনিয়র শিক্ষকের যদি তার থেকে ভালো গবেষণা থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই পদোন্নতি দেওয়া হবে। যে আগে পাবলিশ করতে পারছে তার আগে পদোন্নতি হচ্ছে এবং এটাই নিয়ম। শুধু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় না সব বিশ্ববিধ্যালয়ে একই নিয়ম। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি হিসাব করলে তো এটা কলেজে রূপান্তরিত হবে।’

পদোন্নতির ক্ষেত্রে আগের নিয়ম না মেনে নতুন শর্ত আরোপের ব্যাপারে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে চাই। আগে আমাদের ভিশন ছিল না এখন আমাদের একটা ভিশন আছে সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে এবং শিক্ষকদের মান বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

কুবি শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালা ঘেঁটে দেখা গেছে, সহকারী হতে সহযোগী অধ্যাপকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক পদে থাকাকালীন কমপক্ষে তিনটি গবেষণা প্রকাশনী থাকার শর্ত রয়েছে। অন্যদিকে সহযোগী থেকে অধ্যাপকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহযোগী অধ্যাপক পদে থাকাকালীন কমপক্ষে পাঁচটি গবেষণা প্রকাশনী থাকার শর্ত রয়েছে। যদিও এই নীতিমালায় প্রকাশনার কোনো মানের উল্লেখ না করে বলা আছে ‘স্বীকৃত প্রকাশনায় প্রকাশিত বা প্রকাশনার জন্য গৃহীত গবেষণা প্রবন্ধই পদোন্নতির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে।

নীতিমালার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত শর্ত আরোপের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘শুধু নীতিমালা দেখেই যদি আমরা প্রমোশন দেই তাহলে তো আমাদের বোর্ড বসাতে হয় না। বোর্ডের কাজ হচ্ছে যাচাই-বাছাই করা। একজন শিক্ষক অধ্যাপক হিসেবে যোগ্য কি না বা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ্য কি না তা যাচাই-বাছাই করা।’

শিক্ষকদের সঙ্গে আরো কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নানা সংকট রয়েছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে এমন অতিরিক্ত গবেষণা করার জন্য এখনো পরিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে উঠেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট অনেক। একেক শিক্ষককে চার থেকে পাঁচটা করে কোর্স নিতে হচ্ছে। ক্লাসে এত সময় দিয়ে অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করে এক বছরের মধ্যে স্বনামধন্য জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। এতে করে ভুক্তভোগী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এই ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, ‘যারা বলছেন শিক্ষক সংকট তারা বছরের পর বছর বিদেশ থাকছেন। বিদেশে যে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কোনো শিক্ষক দেশে আসলে এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং শিক্ষার্থীদের জন্যই ভালো কিন্তু দেখা যায় কেউ কেউ ফিরে আসে না আবার কেউ দুই বছরের জায়গায় চার বছর ছুটি কাটায় তাহলে শিক্ষক সংকট হবে না কেন?’

শিক্ষকদের অভিযোগ উপাচার্য একেক শিক্ষকের জন্য একেক ধরনের শর্ত আরোপ করছেন কোন শিক্ষককে দুইটা করে বড় মাপের জার্নালে গবেষণা কাজ প্রকাশ করতে বলছেন আবার কাউকেই কোনো শর্তই দিচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ উপাচার্যের যারা কাছের তাদের কোনো শর্ত দিচ্ছেন না।

এই ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, ‘আমার কোনো কাছের বা দূরের লোক নেই সবাই আমার সমান। যাদের আগে থেকে ভালো গবেষণা আছে তাদের অতিরিক্ত কোনো গবেষণা করতে বলা হয়নি যাদের নাই তাদের বলা হয়েছে। একটা পদে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম কোয়ালিটি থাকা প্রয়োজন যদি কিছুই না থাকে তাহলে কীভাবে প্রমোশন দেওয়া হবে?’

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, আগে ছিল স্বীকৃত জার্নালে একটা পেপার পাবলিশের নিয়ম। তিনি ইউজিসির নিয়মে ভালো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালের কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কী এমন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন যে তিনি কিউ-ওয়ান, কিউ-টু মানের জার্নালে পাবলিকেশন চান? গবেষণার পরিবেশ তৈরি না করেই এভাবে পুশ করলে তো হবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘গবেষণা কিন্তু সিঙ্গেল অথরে সহজে হয় না। এখানে সিঙ্গেল অথোর, ফাস্ট অথোর এগুলো কেন? একজন শিক্ষক ক্লাস-পরীক্ষা কিছু না নিয়ে শুধু গবেষণা নিয়ে থাকবে নাকি।’

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘স্থায়ীকরণের বিষয়টি নির্ভর করে কোনো শিক্ষকের নিয়োগপত্রের মধ্যে কী লেখা আছে তার ওপর। এ উপাচার্য আসার আগ পর্যন্ত ক্রাইটেরিয়া ফিলাপ হয়েছে কিন্তু স্থায়ীকরণ হয় নাই এমন হয়নি। আমার ক্রাইটেরিয়া ফিলাপ হওয়ার পর তিনবার আবেদন করার পরও আমার সঙ্গে শত্রুতা করে স্থায়ী করেনি। স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে কখনো কোনো শিক্ষককে বোর্ডে ডাকানো হয় না। অথচ একমাত্র আমাকে ডেকে অপমান করা হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘একজন স্বাধীন শিক্ষক হিসেবে আমি কোনো সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিতেই পারি। এ বিষয়টাও তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করেছেন। শিক্ষকদের তিনি এক বছরে দুই তিনটা গবেষণা কিউ-ওয়ান জার্নালে প্রকাশের কথা বলছেন। একটা গবেষণাই তো কিউ-ওয়ান মানে তৈরি করতে এক বছরের বেশি লাগে। তার ওপর তো এর জন্য পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্টও নেই। যোগদানের পর থেকে তিনি কোনো আইন তো মানছেনই না, নিজের মনমতো কাজ করে যাচ্ছেন।’

ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, একটা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূলভিত্তি হলো গবেষণা এই জায়গাটাতে উপাচার্য স্যার গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু কাকে কী শর্ত দিচ্ছে সেটা বোর্ডের বিষয় এই বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে যাই না।

সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘পদোন্নতির বেলায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটা কাঠামো আছে। তাদের আপগ্রেডেশন বোর্ড ও নীতিমালা আছে। সেখানে দেশসেরা অধ্যাপকরা থাকেন। তাদের দুজন আমাদের সিন্ডিকেট থেকে এবং তিনজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য থাকে এবং আমি পদাধিকারবলে চেয়ারম্যান। এখানে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন। এতে কারো কোনো প্রভাব নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close