নৌপথে একসময় জমজমাট বাণিজ্য চলতো বাংলাদেশের রাজশাহীর সঙ্গে ভারতের মুর্শিদাবাদের। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর থেকে মুর্শিদাবাদের ময়া নৌবন্দর- এই রুটে চলতো পণ্য আনা-নেওয়া। তবে ৬০ বছর আগেই বন্ধ হয়ে যায় এই নৌরুট। এতদিন পণ্য আনা-নেওয়া হতো সড়ক ও রেলপথে। এতে পণ্য পরিবহন খরচও বেশি হতো। অবশেষে ফের চালু হচ্ছে সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর। মুর্শিদাবাদ হয়ে ফের চালু হচ্ছে নৌবাণিজ্য।

জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর আগামী সোমবার বাংলাদেশ সীমান্তের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনের পরে রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ ঘাট নদীবন্দরের মর্যাদা পাবে। সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে সময় ও খরচ দুটোই কমবে। এতে দুদেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, বছরে এই নৌপথে দুদেশের মধ্যে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।

এর আগে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশের রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ধুলিয়ান নৌরুটে বাণিজ্য চালুর। রাজশাহী থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার একটি নৌপথের অনুমোদন থাকলেও পদ্মার নাব্যতা সংকটের কারণে কার্যকর করা হয়নি। ফলে রুটটি সংক্ষিপ্ত করে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদের ময়া নৌবন্দর পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে ২০ কিলোমিটার পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুরুতে এই নৌপথে ভারত থেকে পাথর বালি ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী আনা হবে।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, নৌবন্দর করার লক্ষ্যে বেশ জোরেসোরে কাজ চলছে। পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে রাস্তা। পল্টুন তৈরি কাজও শেষের দিকে। পাশেই রাখা হয়েছে বিশাল আকৃতির একটি ট্রলার। এই ট্রলার দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতে পণ্য পাঠানোর কথা রয়েছে। নৌবন্দর ঘাটের পাশে রাখা আছে সারি সারি ইট। পলি মাটিতে এই ইট দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হবে।

সুলতানগঞ্জ ঘাটে কাজের তদারকি করছিলেন বিআইডব্লিউটিএ উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম। তিনি জানান, দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। আগামী সোমবার এই নৌবন্দরে উদ্বোধন করা হবে। এখানে নৌ ও পরিবহন মন্ত্রণালয় বিশাল প্রজেক্ট ঘোষণা করবে। এখানকার জায়গাগুলো অধিগ্রহণ করা হবে। সরাসরি মহাসড়কের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। এই নৌরুটে নাব্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এখানে অনেক পানি আছে। পণ্য পরিবহন শুরু হলে চর আর থাকবে না। ড্রেজিং করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুলতানগঞ্জ থেকে ময়া নৌঘাটের নদীপথে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। সুলতানগঞ্জ নৌ-ঘাটটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণের পদ্মার শাখা নদী মহানন্দার মোহনার কাছাকাছি। সারা বছর সুলতানগঞ্জের এই পয়েন্টে পানি থাকে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের ময়া নৌ ঘাটটি মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমা শহরের কাছে ভারতীয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে যুক্ত। ফলে সুলতানগঞ্জ-ময়া পথে নৌবাণিজ্য শুরু হলে পরিবহন খরচ অনেকাংশে কমে যাবে।

এই নৌবন্দর চালু হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান বলেন, একসময় এখানে নৌবন্দর ছিল। অনেক দিন থেকে বন্দরটি বন্ধ আছে। এখানে নৌবন্দর চালু হলে স্থানীয় বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এটি ইতিবাচক।

সুলতানগঞ্জ ঘাটের চা দোকানি মো. সেলিম হোসেন বলেন, ঘাটে প্রতিদিন ৫০টি নৌকা যাওয়া আসা করে। ভোর থেকে নৌকা চলাচল শুরু হয়ে চলে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে। এখানে বন্দর করা হলে সব সময় মানুষের যাতায়াত থাকবে। তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে আরো গতি আসবে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলের আওতায় নদীপথে দুদেশের মধ্যে কম খরচে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। রাজশাহীর সুলতানগঞ্জে নৌবন্দরের কার্যক্রম চালু হলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ময়া নৌবন্দরের সঙ্গে নদীপথে বাণিজ্য শুরু হবে। এর ফলে দুদেশের ব্যবসায়ীরাই উপকৃত হবেন। সুলতানগঞ্জ-ময়া একটি লাভজনক ও চমৎকার নৌরুট হতে পারে। দুই পাড়েই অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে সুলতানগঞ্জ বন্দর চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সেগুলো ঠিক করা হবে। ভারত ময়া ঘাটও প্রস্তুত করেছে। উদ্বোধন হলে পণ্য পরিবহন শুরু হবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ভারতের মুর্শিদাবাদের ধূলিয়ান থেকে গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ, রাজশাহী, পাকশী হয়ে আড়িচাঘাট পর্যন্ত এই নৌরুট। দীর্ঘদিন এটির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমি গত পাঁচ বছর থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, লেখালেখি বা ডিও লেটার দেওয়ার কাজ করেছি। এর ফলে এটা গতিশীল হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ উভয়পক্ষ বিশেষ করে ভারত নৌপথে বাণিজ্য করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্তের সাতটি প্রদেশ আছে সেগুলোয় সুলভে মালামাল পৌঁছে দিতে তারা নৌপথে বাণিজ্য করতে চাই। এই নৌরুটটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।

"