নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

ব্যাংকমুখী হচ্ছে তহবিলপ্রবাহ

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি কাজে দিচ্ছে এমন আভাস মিলছে, কারণ আবারও ব্যাংকমুখী হতে শুরু করেছে তহবিলের প্রবাহ। এই প্রবণতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হবে, যা গত বছরের মার্চ থেকে ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের ১৪ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার তুলনায় যা বেশিই হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে পৌঁছায় ১১ দশমিক ০৪ শতাংশে। এই হার গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করোনা মহামারির বৈশ্বিক লকডাউন ও সেকারণে হওয়া অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার প্রভাবে আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে পৌঁছেছিল।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, স্মার্ট রেট অনুযায়ী সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগে (ঋণে) সর্বোচ্চ সুদহার ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে তারল্য সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক আরো প্রতিযোগিতামূলক হারে, সর্বোচ্চ ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। আমানতে প্রবৃদ্ধির যা অন্যতম প্রধান কারণ। তিনি বলেন, অনেক ইসলামী ব্যাংকই ব্যাপক তারল্য সংকটে রয়েছে, ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক জমা সঞ্চিতির অনুপাশ নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা অনুপাত (স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও বা এসএলআর) রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে উচ্চ সুদহার দিয়ে এসব ব্যাংককে আমানত আকৃষ্ট করতে হচ্ছে।

সুদহার বাড়ানোর সুফল পাচ্ছেন সঞ্চয়কারীরাও। এর আগে এক বছরের বেশি সময় ধরে আমানতের সুদহার ছিল মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে নিম্ন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতের হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে পিছিয়ে পড়লেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আমানতকারীরা সঞ্চয় করাকেই বেছে নিয়েছেন। তা ছাড়া, ব্যালেন্স শিট দৃঢ় করতে ব্যাংকগুলোও সাধারণত বছরের শেষদিকে এসে আমানত বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোরেশোরে প্রচারণা চালায়।

২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহারে এক অংকের যে সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহারের পরেই আমানতে সুদহার বাড়তে শুরু করে। গত বছরের জুনে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হয়। তবে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ হওয়ার পরেও প্রধান প্রধান ব্যাংকগুলো আমানতে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যসূত্রে এমনটাই জানা গেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণের সুদহারে সীমা তুলে নেওয়ার কারণে গ্রাহকের আমানতের সুদহার বাড়ছে। আমাদের অর্থনীতির জন্য এটি একটা পজেটিভ দিক।

তিনি বলেন, পলিসি রেট (নীতি সুদহার) বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের সুদহারে তার কিছুটা প্রতিফলন তৈরি হয়েছে। যদিও এখনো মুল্যস্ফীতি রেটের তুলনায় আমানতের রেট কম। আমানতের রেট আরো বাড়াতে হলে লেন্ডিং রেট (ঋণের সুদহার) আরো বাড়তে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, নতুন চালু করা সংকুলানমূলক মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের তহবিল ব্যাংকে নিয়ে আসা। যা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার সহায়ক হয়।

মেজবাউল হক বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে অবশ্যই প্রভাব পড়বে, কারণ আমরা চাচ্ছি ঋণের প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে অর্থের জোগান কমিয়ে আনতে। যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে তখন পুনরায় প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে।

২০২৩ সালের জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার সীমা তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্মার্ট রেট ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরে সুদহারের ব্যবধানের (স্প্রেড) সীমাও তুলে নেওয়া হয়।

সুদহারের ব্যবধান হলো, ব্যাংকগুলো বেসরকারি গ্রাহকদের যে সুদে ঋণ দেয়, তা থেকে বাণিজ্যিক বা অন্যান্য ব্যাংক ডিমান্ড, মেয়াদি বা সঞ্চয়ী আমানতের বিপরীতে আমানতকারীকে যে হারে সুদ দেয়, তা বাদ দিলে যা পাওয়া যায়, সেই পার্থক্য।

ব্যাংকাররা বলছেন, এসব পদক্ষেপের কারণে ব্যাংকগুলো এখন উচ্চ সুদহারে আমানত নিতে পারছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে গ্রাহকের ঋণের রেট পরিবর্তন হচ্ছে ৬ মাসের ট্রেজারি-বিল বন্ডের গড় রেটের (স্মার্ট) ওপর ভিত্তি করে। এর সঙ্গে আরো ব্যাংকগুলো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে গ্রাহকে ঋণ দিতে পারে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির জন্য ঋণের সর্বোচ্চ রেট হবে ১২.৪৩ শতাংশ।

তিনি বলেন, যখন ঋণ-আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ৪ শতাংশ রাখার সীমা ছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলো চাইলে ১ শতাংশের কমও স্প্রেড রাখতে পারে। যেকারণে ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য উচ্চ সুদহার দিতে পারছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ৩৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close