নিজস্ব প্রতিবেদক
মেট্রোরেলের শহরে অবহেলিত বাস সার্ভিস
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে রাজধানী ঢাকা। মেট্রোরেলের শহরে লক্কড়-ঝক্কড় বাস সার্ভিস অনেকটাই অবহেলিত। মেট্রোরেলের সঙ্গে মিলিয়ে প্রয়োজন যুগোপযোগী বাস সার্ভিস। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেট্রোরেল যেহেতু আরামদায়ক এবং সময় সাশ্রয়ী, কাজেই যাত্রীরা এটিকে অগ্রাধিকার দেবেন। ফলে বাসের চাহিদা কমে যাবে।
অনেক চেষ্টার পরও ঢাকার রাস্তায় বাসের রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, আবদুল্লাহপুর ও গাবতলীতে চলাচলরত ১৫টি কোম্পানির বাসে ই-টিকিট সার্ভিস চালু হলে যাত্রীদের কোনো উপকারে আসেনি। ফলে এসব সেবা মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে প্রয়োজনে সব কোম্পানির বাসকে এক ছাতার নিচে এনে আধুনিক সেবা নিশ্চিত করা উচিত।
জানা গেছে, বিশ্বের যেকোনো শহরে মেট্রোরেল থাকা মানেই এটা নিশ্চিত, ওই শহরে আগে থেকেই যাত্রীবান্ধব উন্নত বাস সার্ভিস সেবাও নিশ্চিত থাকবে। বিশ্বের নামিদামি শহরগুলোর নগর গণপরিবহনের ধরনটাই এমন। কারণ উন্নত ও সুশৃঙ্খল বাস ব্যবস্থাপনা একটি শহরের মেরুদণ্ডের মতো। কিন্তু রাজধানী ঢাকার সেই মেরুদণ্ডটাই অনুপস্থিত। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প হলো ঠিকই, কিন্তু বাসের সেবাটা যেন সেই আশির দশকেই পড়ে আছে। সব বাস কোম্পানিকে একটি ছাতার নিচে আনাটা যেন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে চালু হওয়া ঢাকা নগর পরিবহন এখন লোকাল বাস সার্ভিসে রূপ নিয়েছে। নির্ধারিত স্পট থেকে যাত্রী ওঠানামা, নির্ধারিত ভাড়া ও উন্নত যাত্রী সেবার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল; তার কিছুই রক্ষা করতে পারেনি নগর পরিবহন। তিন রুটের একটিতে নগর পরিবহনের আওতায় চলা বেসরকারি বাসগুলো এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অল্পকিছু বিআরটিসি বাস দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে এ পরিবহন সেবা। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাসরুট রেশনালাইজেশনের আওতায় চালু হয় নগর পরিবহন। প্রাথমিকভাবে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত চালু হয় একটি রুট। পরে আরো দুটি রুটে চলে নগর পরিবহনের বাস।
শুরুটা অবশ্য ভালোই ছিল। নির্ধারিত জায়গায় যাত্রী ওঠানামা, বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া, চমৎকার যাত্রীছাউনি। কিন্তু সেই পরিবহনের এখন বেহাল দশা। লোকাল বাসের মতো চলছে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা। উধাও নির্দিষ্ট সময় পরপর বাস ছাড়ার নিয়মও। যাত্রীছাউনিগুলোর অবস্থাও বেহাল। বাসের রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় তিনটি রুটে চালু হওয়া ‘নগর পরিবহন’ এক ব্যর্থ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। তিনটি রুটেই বাস চলা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় পুরো শহরে আধুনিক বাসের নেটওয়ার্ক আদৌ কি সম্ভব?
রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন জানান, ‘রেশনালাইজেশনের মাধ্যমে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় বাসের রুট ৪২টিতে নামিয়ে আনা হবে। বাসগুলো ওই ৪২টি রুটের সরকারনিয়ন্ত্রিত ২২টি কোম্পানির অধীনে থাকবে। অপ্রয়োজনীয় বাস রুট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এখন শত শত রুট রয়েছে যার কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন গাজীপুর থেকে ঢাকায় ৪০-৫০টি রুট আছে। একেকটি কোম্পানি তাদের সুবিধা অনুযায়ী রুট তৈরি করে নিয়েছে। ফলে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যাত্রীরা বেশি ভাড়া গুনতে বাধ্য হচ্ছেন।’
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, পাইলটিংটা আসলে যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। আমাদের একই রুটে যে বাসগুলো আছে, সেগুলোর সবই লক্কড়-ঝক্কড়, রোড পারমিট নেই, ফিটনেস নেই- এরকম বাসগুলোই চলছে। এর মধ্যেই আমরা নগর পরিবহনের বাসগুলো নামিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাসগুলোর মধ্যে রেষারেষি, যানজট ও দুর্ঘটনা কমানো। তবে লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো রেখেই যখন পাইলটিং করা হয়, তখন এ ধরনের উদ্যোগ যে মুখ থুবড়ে পড়বে- এটা আগেই জানা ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল নির্দিষ্ট রুটের যাত্রীদের সুফল দেবে। কিন্তু পুরো শহরে মানুষের রোজকার চলাফেরার জন্য বাসের বিকল্প নেই। তাই সবার আগে আধুনিক বাস সার্ভিস চালু করতে হবে, যা অনেক বছর আগেই সুপারিশ করা হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যে শহরে মেট্রোর মতো উন্নত পরিবহন একটা সিস্টেমে চলছে, সেখানে নগর পরিবহনের বাস সার্ভিসকে কেন মানসম্পন্ন রূপ দিতে পারলাম না। এটা অনেক বড় ব্যর্থতা। তিনি বলেন, সরকার যখন মেট্রোকে নিয়ে তার সাফল্যের গাথা গাইছে, তখন কেন বাস সার্ভিস অকেজো পড়ে আছে। সেই ব্যর্থতার দায়ভারও সরকারকে নিতে হবে। নগর পরিবহন ব্যর্থ হওয়ার বড় কারণ লভ্যাংশ নিয়ে মালিকদের অসন্তোষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরো বড় পরিসরে বাস রুট রেশনালাইজেশন বাস্তবায়নের আগে বিষয়টি সুরাহা করতে হবে।
"