প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধে কিসিঞ্জারের নিন্দনীয় ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে নামগুলো সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, সেই তালিকায় হেনরি আলফ্রেড কিসিঞ্জারের নাম রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। তিনি মদদ জুগিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাশেদেশের পক্ষে ছিল। প্রায় ১ কোটিরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। এজন্য ভারতের কঠোর নিন্দা করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। এ শণরার্থীদের মধ্যে বিপুলসংখক মুসলিমও ছিল। এ প্রতিবেদন লেখা হয়েছে বিবিসি বাংলার তথ্য ও বিশ্লেষণ অবলম্বনে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করা এক মন্তব্যের সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারের নাম জড়িয়ে রয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটে মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিচক্ষণ কূটনীতিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা কেমন ছিল? আর বাংলাদেশ নিয়ে তার অবস্থান আর মন্তব্যই-বা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমার চোখ ফিরাছি ইতিহাসের পাতায়। ১৯২৩ সালে জার্মানিতে জন্ম নেন হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৩৮ সালে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। ১৯৪৩ সালে তিনি দেশটির নাগরিকত্ব লাভ করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন কিসিঞ্জার। মার্কিন রাজনীতিতে তিনি প্রবেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের হাত ধরে। ১৯৬৮ সালে রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর হেনরি কিসিঞ্জারকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন।

হোয়াইট হাউসেই বসার জন্য একটি কক্ষ দেওয়া হয় তাকে। তারপর আর কিসিঞ্জারকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা আর প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি থাকার সুবিধা নিয়ে কম সময়েই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে নিক্সন প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনসহ দেশটির ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী কূটনীতিক হিসেবে নিজের জায়গা পোক্ত করে নেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য নেওয়া বিতর্কিত নীতি ও পদক্ষেপের জন্য তাকে ঘিরে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই অনেক বেশি ছিল। বিশেষ করে তার সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, চিলির অগাস্টো পিনোশেসহ বিশ্বজুড়ে বহু কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক গোষ্ঠীকে সমর্থন, কম্বোডিয়ায় বোমা ফেলা- যাতে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়; এমনকি চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদোর গিইয়ের্মো আইয়েন্দেকে উৎখাত ও প্রাণনাশ- এমন বহু ঘটনায় বারবার নাম জড়িয়ে আছে হেনরি কিসিঞ্জারের।

আবার তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়েই প্যারিসে ভিয়েত কংয়ের সঙ্গে জটিল আলোচনার পর ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। যে কারণে তিনি উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৭৩ সালে তার কূটনীতির কারণেই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে একটি অস্ত্রবিরতি হয়েছিল। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ তৈরির পেছনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার বাস্তব রাজনীতির কূটনীতিক হিসেবে তাকে মনে করেন অনেকেই, তাকে বিবেচনা করা হয় ‘রিয়েল পলিটিক’র মূর্ত প্রতীক হিসেবে। রাজনীতিতে ‘রিয়াল পলিটিক’ বলতে বোঝানো হয় যে বা যারা নীতি-আর্দশের বদলে বরং নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

সত্তরের দশকে যখন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তুমুল স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নেকে ঠেকাতে ভিন্ন এক পথ ধরার পরিকল্পনা করে নিক্সন প্রশাসন। সেসময় চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সেটাকেই লুফে নিয়ে দুই কমিউনিস্ট দেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করে নিক্সন প্রশাসন। আর একাজে ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, সেখানে রাশিয়াকে আটকানো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। তারা বন্ধুত্ব করেছে রাশিয়ার শত্রু চীনের সঙ্গে। এখানে দুটি সমীকরণ হয়ে গেছে। একদিকে আমেরিকা, পাকিস্তান আর চীন; অন্যদিকে রাশিয়া আর ভারত।’ এ সমীকরণের ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন তার সিপাহ সালার।

এমনকি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে চালানো ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সম্পর্কে আগে থেকে জানলেও নীরব ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। তখন ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ও নিউইয়র্কের সাবেক রিপবালিকান সিনেটর কেনেথ বি কেটিং ওভাল অফিসে ব্যক্তিগতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ করে চালানো গণহত্যার কথা বলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসন কেনেথ বি কেটিংয়ের এ প্রতিবেদনের গুরুত্ব দেয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো গণহত্যাকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন করেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধে সহায়তা ও ইন্ধন দেওয়া সমানভাবে শাস্তিযোগ্য। কিসিঞ্জারের ভূমিকা হচ্ছে (বাংলাদেশের) গণহত্যার বর্বরতার সঙ্গে জড়িত থাকার সমতুল্য।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আশফাক হোসেনের মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিন্দনীয় বললে কম হবে।

‘পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যে গণহত্যা করে, তাতে পেছনে যিনি শক্তি জুগিয়েছেন, রসদ জুগিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন; এমনকি পরিকল্পনা করেছিলেন তার মধ্যে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা সামনে থাকবে’, বলেন তিনি। যে দুটি কারণে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে পরিচিত, তার একটি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতি তার সমর্থন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করা। তবে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা বলছেন, এ মন্তব্য কিসিঞ্জারের ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব দ্য হিস্টোরিয়ানে প্রকাশিত নথিতে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক মিটিংয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফল আর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে চলমান আলোচনায় জনসন নামে এক কূটনীতিক এ মন্তব্য করেন। মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচিন্স ২০০১ সালে তার দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close