বদরুল আলম মজুমদার

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে বিদেশনির্ভর বিএনপি

আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে। মাঠের আন্দোলন দিয়ে নির্বাচন ঠেকানোর মতো সামর্থ্য দলটির নেই। তাই যেকোনোভাবেই নির্বাচন ঠেকাতে দলটির শীর্ষ নেতারা এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশের ওপর ভরসা করে আছে, তাদের মানসিক নির্ভরতাও বিদেশনির্ভর। আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর মতো অবস্থায় বর্তমানে নেই বিএনপির। এ কারণে বিদেশ নির্ভরতার পাশাপাশি আন্দোলন জমানোর জন্য পরিকল্পনা করছে দলটি। আগামী ১৮ ডিসেম্বরের পর থেকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে চলতি সপ্তাহ শেষে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে সাময়িক বিরতি দেওয়া হতে পারে। নেতাকর্মীদের কিছু দিন ‘রিলাক্স’ দিতে আন্দোলন চাঙা করতে আপাতত হরতাল-অবরোধ কিছু দিন না দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। দলটির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, তাদের এখন মূল টার্গেট ‘একতরফা’ নির্বাচন ঠেকানো।

দলটির সিনিয়র নেতাদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপি ভাঙার যে তৎপরতা ছিল তাতে কোনো মহলই সফল হয়নি। নেতাদের মূল্যায়ন, নানা চাপ ও প্রলোভন থাকার পরও দল ভাঙার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে সরকারের পরিকল্পনাও হোঁচট খেয়েছে। এটি বিএনপির একটি বড় সাফল্য। এছাড়া জাতিসংঘসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলো দেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিনিয়তই কথা বলছে। তারা এবারের নির্বাচন যেনতেন ভাবে সেটা চায় না। তাই শেষ সময়ে নির্বাচন হওয়া না হওয়া নিয়ে কঠিন এক সময় আসতে পারে।

সূত্র মতে, ভোটকেন্দ্রিক কর্মকৌশল ঠিক করতে গত কয়েক দিন ধরেই ম্যারাথন বৈঠক করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। নেতারা জানিয়েছেন, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দেশজুড়ে অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন ভোট ঠেকাতে নতুন ছকে আন্দোলন সংগ্রাম জোরদার করতে ফের রাজপথে সরব হতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন উপায়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের মূল টার্গেট এবার নির্বাচন ঠেকানো। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আমরাও যে অনড় অবস্থানে আছি সেটি জানান দিতে হবে। শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। দাবি আদায়ে আমাদের হরতাল-অবরোধ চলছে; ভোট ঠেকানোর আন্দোলন জোরদার করতে আগামীতে আরো ভিন্ন ধাঁচের কর্মসূচি আসবে।

এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিশ্বাস, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে সংলাপে বসতে মার্কিন আহ্বান উপেক্ষা, তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা এবং প্রধান বিরোধী দলগুলো আন্দোলনের মাঠে রেখে সরকার যে একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটছে এর পরিণাম ভালো হবে না। সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া আসবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিক থেকে। তাদের এ ধারণার কারণ হলো, নির্বাচন নিয়ে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের দিক থেকেও নির্বাচন নিয়ে প্রতিনিয়ত বক্তব্য বিবৃতি আসছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এরই মধ্যে এ নিয়ে বেশ শক্ত ভাষায় একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে।

সূত্র জানায়, রাজপথের আন্দোলনে না থাকলেও কূটনৈতিক তৎপরতার জোরদার করছে বিএনপি। ঢাকায় নিযুক্ত সব দূতাবাসে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্সে নতুন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দুই মাসের জন্য ঢাকায় আসা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) চার সদস্যের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছে বিএনপি। গত শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান ও মানবাধিকার সম্পাদক আসাদুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল দেশের ভেতরে নয় বরং বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মননশীল মানুষের সামনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেভাবে একটি কলঙ্কময় ভাবচিত্র প্রতিস্থাপন করবে সে বিষয়ে বাস্তব চিত্র আমরা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের জানাচ্ছি। বিএনপির এই নেতার দাবি- গত ২৮ অক্টোবর থেকে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সারা দেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের নিপীড়ন করা হচ্ছে সেটি বিশ্বসম্প্রদায় দেখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বও এই নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতার প্রশ্ন তুলেছে। তারা যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল, সরকার তা আমলেই নেয়নি। ফলে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকও পাঠাচ্ছে না। কারণ তারা বুঝে গেছে নির্বাচনের নামে এখানে কত বড় প্রহসন হতে যাচ্ছে।

এ দিকে আগামী ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়টাকে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘মোক্ষম ক্ষণ’ ধরে আন্দোলনে জোরদারের পরিকল্পনা রয়েছে। আপাতত হরতাল-অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষোভণ্ডসমাবেশ জাতীয় কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর আগে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে বিদেশিদের কাছে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে। ওই দিন রাজধানীতে মানববন্ধন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া যুগপতে থাকা দলগুলোর অঙ্গ সংগঠনকে নিয়ে ঢাকায় নারী সমাবেশ, যুব সমাবেশ, শ্রমিক সমাবেশ, ছাত্র সমাবেশের কথাও ভাবছে বিএনপি। একই সঙ্গে বিএনপির কারাবন্দি, গুমণ্ডখুন ও নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীর স্বজনদের নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় জনসম্পৃক্ত এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায় দলটি।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের মতে, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হওয়ার ফলে এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নির্বাহী বিভাগের ওপর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকার পরও বিএনপির আন্দোলন দমানো এবং নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হলে তাতে ইসির ভূমিকা আরো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা নিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহল প্রশ্ন দেখা দেবে। তা ছাড়া তফসিলের পর এখন ইসির আচরণও যদি সরকারের মতো হয় তাহলে প্রমাণ হবে একতরফা নির্বাচনের আয়োজনের সব ব্যবস্থা তারা করছে। বিএনপি তখন তা সামনে নিয়ে আসবে।

জানা গেছে, আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলো এক জায়গায় আনার চিন্তা করছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, নির্বাচন বর্জনকারী সব রাজনৈতিক দল এক জায়গায় এসে ভূমিকা রাখলে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনের গতি বাড়বে।

সূত্র জানায়, ৬০টি দল ও জোট অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারাও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে কর্মসূচি যুগপৎ নাকি এক জায়গা থেকে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির কৌশল নেওয়া হবে, সে বিষয়ে নেতাদের মত নেওয়া হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close