যে শিশুরা শহরের আশপাশে, ফুটপাতে প্লাস্টিক, বোতল, পলিথিন কুড়াত। কেউ ভিক্ষা বৃত্তি করত, কেউবা বাসাবাড়িতে কাজ করত। এমনকি অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ত অনেকে। কারো আবার মা নেই, কারো নেই বাবা, কারো আবার মাথা গুজার ঠাঁইটুকু নেই। আর এমন অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোর পথ দেখাচ্ছে স্বপ্নসিঁড়ি। ছিন্নমূল শিশুদের আলোর পথ দেখানোর এক উদীয়মান সূর্য, তারুণ্যনির্ভর সংগঠন স্বপ্নসিঁড়ি। শিশুদের নিয়ে অক্ষর জ্ঞানের পাশাপাশি নৈতিক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার এ কাজটি করে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া এক ঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী।

রংপুর বাবুপাড়া রেলস্টেশন এলাকার শুক্রবার এবং শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঠশালায় চলে পাঠদান। এই পাঠশালায় বর্তমানে ৬৫ শিশু শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। ৬৫ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ শিক্ষার্থী নিয়মিত পাঠদান করাচ্ছেন।

শিশুরা হচ্ছে ভেজা মাটির মতো এর উপর যা কিছুই পতিত হয় তার ছাপ ফুটে ওঠে। সেই লক্ষ্যকে ‘হাত বাড়াই মানবতার সেবায়, লক্ষ্য মোদের আকাশ ছোঁয়ায়’ এই স্লোগান সামনে রেখে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় ৩ মার্চ ২০১৮ সালে পথশিশু এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বপ্নসিঁড়ি পাঠশালা।

যেখানে অধিকার বঞ্চিত শিশুদের জন্যে বিনামূল্যে পাঠদানের পাশাপাশি বিনামূল্যে বই, খাতা-কলম, ব্যাগসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়। নিয়মিত নেওয়া হয় পরীক্ষা, মেধাক্রম অনুসারে পুরস্কার প্রদান এবং খাবারের ব্যবস্থা করা হয় যাতে করে শিশু শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে দূরে সরে না যায়। পাশাপাশি অভিভাবকদের নিয়ে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। যাতে করে তাদের শিশুদের পাঠদানের উৎসাহ দেন তারা।

শিশু শিক্ষার্থী সুমন বলেন, ভাইয়া ও আপুরা আমাদের শিখিয়েছে বড়দের দেখলে সালাম দিতে হয়, বড়দের সম্মান করতে হয়, সব সময় সত্য কথা বলতে হয়। আমি প্রতি শুক্রবার ও শনিবার পড়তে আসি, ভাইয়া ও আপুরা আমাদের অনেক আদর করেন।

আরেক শিশু শিক্ষার্থী রোজা বলেন, এখানে অনেক সুন্দর করে আমাদের পড়ায়। আমি এখানে এসে অ, আ, ই, ঈ শিখেছি এবং ১, ২, ৩, ৪ শিখেছি। আপু ও ভাইয়ারা আমার নাম কীভাবে লিখতে হয় তা শিখেছেন।

কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী রাশিদুল ইসলাম রিপন জানান, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য স্বপ্নসিঁড়ি সংগঠন প্রশংসার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অধিকার বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে কাজ করে আসছে। এ ছাড়া নানা ধরনের স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজ করে থাকে স্বপ্নসিঁড়ির স্বেচ্ছাসেবীরা। স্বপ্নসিঁড়ি সর্বদা বিশ্বাস করে মানবিক সমাজ গঠনে সবার অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজনীয়।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জেমি আক্তার বলেন, আমার মন খারাপ থাকলেও এখানে এসে শিশুদের পড়ালে মন ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে শিশুরা অনেক দুষ্টুমি করে এরপরও এখানে পড়াতে ভালো লাগে এবং এখানে পড়াতে এসে আমি খুব খুশি। নিজেকে ধন্য মনে করি এই ধরনের সামাজিক কাজ করার সুযোগের জন্য।

বেরোবির ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাজমুস সাকিব বলেন, ভালো লাগা ও ভালোবাসার আরেক নাম স্বপ্নসিঁড়ি পরিবার। এই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমি গর্বিত। স্বপ্নসিঁড়ি এমন একটি জায়গা যেখানে গেলে মানসিক প্রশান্তি ও ভালোবাসা মিলে। পরিবারে গেলে যে প্রশান্তি পাওয়া যায় তা আসলে আর কোথাও পাওয়া যাবে না আর কোটি টাকা দিয়েও তা কেনা সম্ভব না।

স্বপ্নসিঁড়ির সাধারণ সম্পাদক ফাতিহুল ইসলাম শোভন বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য স্বপ্নসিঁড়ি সংগঠন প্রশংসার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া নানা ধরনের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করে থাকে স্বপ্নসিঁড়ির স্বেচ্ছাসেবীরা। স্বপ্নসিঁড়ি সর্বদা বিশ্বাস করে মানবিক সমাজ গঠনে সকলের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজনীয়।

সভাপতি জি এম ইমরাস বলেন, সংগঠনটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অধিকার বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে কাজ করে আসছে। এই সংগঠন আমাদের আবেগ ও অনুভূতির জায়গা। আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে অধিকার বঞ্চিত শিশুদের পাশে থাকতে চাই। শিক্ষার আলোয় তাদের আলোকিত করতে চাই। একটি শিশুও যেন শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই। সভাপতি হিসেবে আমি যেন আমার কাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারি সেই লক্ষ্যে সবার সহযোগিতা কামনা করি।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩ মার্চ থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) স্বপ্নসিঁড়ি যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি।

"