হাফিজুর রহমান, ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল)

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

জীবন সংগ্রামে সফল নারী

কষ্টের জীবন সংগ্রাম লড়াইয়ের পথ অতিক্রম করে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর পাঁচজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জীবন সংগ্রামের সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। সরেজমিনে গিয়ে কথা বলে জানা গেছে, নারী জয়িতা ধনবাড়ী উপজেলার পৌর শহরের কিশামত গ্রামের ফজর আলীর ছেলে বাবলু মিয়ার স্ত্রী ময়না বেগম। তিনি তার বাবার ঘরে বড় মেয়ে সন্তান হওয়ায় তার মাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক কষ্ট যন্ত্রণা। পরে ১২ বছর বয়সেই একই এলাকার বাবলু মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন বাবা। বিয়ের পরে স্বামী বাবলু মিয়া তেমন কোনো কর্ম না করায় শ্বশুরবাড়িতে অর্ধহারে অনাহারে দিনপার করতে হয় ময়না বেগমের। এর মধ্যেই তাদের ঘরে জন্ম হয় এক কন্যাসন্তানের। কন্যাসন্তান হওয়ার পরে শাশুড়ি ও ননদের নির্যাতন বেড়ে যায়।

তৎকালীন সময়ে একদিন বাবার বাড়িতে গেলে সেখানে নিজেরা করি নারীকর্মীর মিটিংয়ে উপস্থিত হন। সেই মিটিংয়ে নারীকর্মী তার দুঃখের গল্প শুনে তাকে ভেঙে না পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে সমিতিতে ভর্তি হয়ে কিছু টাকা জমা করে ও তার মায়ের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে ২৫০০ টাকা দিয়ে টাঙ্গাইলের করটিয়া হাটে থেকে এলাকার অন্য নারী কাপড় ব্যবসায়ীদের মতো সে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। এলাকায় ফেরি করে কাপড় বিক্রি করেন তিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সেই ব্যবসায় টিকতে পারেনি বেশিদিন। কোনো উপায় না পেয়ে ময়না বেগম মধুপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে ১০ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে হাঁস-মুরগির টিকা প্রদানের কাজ শুরু করেন। ২ বছর কাজ করার পরে মেয়ে বড় হতে থাকে পরে সেই দুই বছরে কষ্টার্জিত কিছু টাকা ও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা লোন নিয়ে বাড়ির স্বামীর বাড়ির পাশে আমবাগান মোড়ে একটি মনোহারির দোকান দেন। সেই দোকানের খবর পেয়ে স্থানীয় হুজুর ও সমাজের লোকজন মেয়ে মানুষ দোকান করতে পারবে না এটা শরিয়ত বিরোধী বলে ক্ষিপ্ত হয়ে দোকান বন্ধ করে দেন। আমি সব বাধা উপেক্ষা করে স্বামীকে বুঝিয়ে ব্যবসায় তাকে মনযোগী করিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করাই। বর্তমানে সেই ছোট্ট দোকান থেকে আস্তে আস্তে বড় দোকানে পরিণত হয়েছে। পৌরসভার মধ্যে ৪ শতাংশ জায়গা কিনে পাকা বাড়ি নির্মাণ করে স্বামী ও এক মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সুখে আছি। মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। ময়না বেগমের এ রকম জীবন সংগ্রাম দেখে এলাকার আরো ৩ থেকে ৪ জন নারী দোকান করে সংসার পরিচালনা করে আসছে।

শুধু ময়না বেগমই নয় দরিদ্রতার গল্প জয় করে সমাজের নারীদের এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন উপজেলার কয়ড়া গ্রামের গৃহবধূ আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী জামিলা বেগম। জামিলা বেগমের পড়ালেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকলে দরিদ্র ঘরের মেয়ে হওয়ার কারণে তিনি পড়াশোনা করতে পারেনি। তাকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরই ১৩ বছর বয়সে একই এলাকায় বিয়ে দেন। পড়াশোনা না করতে পারলেও নিজেরা করি ভূমিহীন সমিতির মাধ্যমে দলীয় কর্মকাণ্ডসহ সমাজে নারীর উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি সমাজে বাল্যবিবাহ, দরিদ্র ও অসহায়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। শুধু তাই নয় ২০১২ সালে স্থানীয় পাইস্কা ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। অতীতে তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে আজ তিনি স্বামী ও এক মেয়েসহ ৩ ছেলে নিয়ে সুখে সংসার করছেন।

পৌরসভার চাতুটিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকছেদ আলীর মেয়ে মোর্শেদা বেগম ছোট্টবেলায় দরিদ্র পরিবারে চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। বড় পরিবারে একমাত্র শিক্ষক বাবার সামন্য বেতন দিয়ে কষ্টে পরিবারের ব্যয় ভার করেছিলেন। ওই সময়ে এসএসসি পাস করার পরই মোর্শেদাকে বিয়ে দেন পাশের যদুনাথপুর ইউনিয়নের পাথালিয়া গ্রামের সোহেল রানার কাছে। বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি পরে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হয় তার। বর্তমানে তিনি এলাকার অসহায় দরিদ্র ছেলেমেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা করে আসছেন। তিনি বর্তমানে ধনবাড়ী পৌর শহর এলাকায় নিজস্ব জমি ক্রয় করেছেন। একটি ছেলে সন্তান ও স্বামী নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

এদের মতো জীবন সংগ্রাম করে প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে একটি মাত্র জামা পড়ে প্রাথমিকের গন্ডি পার করেছেন পৌরসভার নিজবর্ণি গ্রামের মোতাহের আলী খন্দকারের মেয়ে মোছা. নুরজাহান বেগম। দরিদ্রতার কারণে প্রাথমিকের শিক্ষা লাভের পরই বিয়ে দেন তার পরিবার। বিয়ের পরে স্বামী পাট অধিদপ্তরের চাকরিজীবী হওয়ায় নুরজাহান বেগমকে ধোপাখালী হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। দুঃখের বিষয় স্বামীর সামান্য বেতন থাকার কারণে এসএসসির ফরম পূরণে ব্যর্থ হয়ে নুরজাহানের পড়ালেখার পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই থেকে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন তিনি তার ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। সেই প্রতিজ্ঞায় আজ চার সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করিয়েছেন। তারা আজ সবাই সরকারি চাকরিজীবী। তিনি আজ একজন সফল নারী। তিনি সমাজে আজও ভালো কাজ করে যাচ্ছেন।

জীবনের কষ্ট সংগ্রাম পিছু ছাড়েনি অরেক অদম্য মেধামী নারী পৌরসভার কিশামত ধনবাড়ী এলাকার মোছওয়ার আহম্মেদ সিদ্দিকীর মেয়ে তাহমিনা সিদ্দিকার। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ । বড় পরিবার ও অভাবের সংসার হওয়ার কারণে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হতো তার। এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করা কালে টাকার অভাবে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন তার পরিবার। কিন্তু স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে স্বামীর বাড়ি থেকে দুটি সন্তান হওয়ার পরে চলে আসতে হয় তার। দুই সন্তান নিয়ে শুরু করেন বাবার বাড়িতে বসবাস। নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে নিজে পাট পণ্যের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে পাট পণ্যে তৈরির কাজ শুরু করে নিজের জীবনের সফলা এনেছেন তিনি। অন্যদেরও এ কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি এলাকায় নিজস্ব জমিতে বাড়ি করে সুখেই রয়েছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close