নিজস্ব প্রতিবেদক
ব্যবসা গুটিয়ে অন্য পেশায় হকাররা
সারা দেশে একসময় যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল নদীপথ। সেই পথের সদর দপ্তর ছিল রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। সড়ক ও রেলপথের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে ধীরে ধীরে নদীপথে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের নির্ভরতা কমেছে, পাল্টেছে দৃশ্যপট। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নদীপথে যোগাযোগ আরো কমে এসেছে। সময় বাঁচাতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার্থে দক্ষিণাঞ্চলের অর্ধেকের বেশি যাত্রী নদীপথে যাতায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যাত্রীর ভাটা পড়েছে নদীপথে, যার প্রভাব পড়েছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের হকারদের ওপর।
পদ্মা সেতু ছাড়াও এক মাস ধরে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের প্রভাব পড়েছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। ধাপে ধাপে হরতাল-অবরোধের প্রভাবে কমেছে লঞ্চের যাত্রী। যাত্রী কমে যাওয়ায় গত এক মাসে সদরঘাটে হকারদের বেচাকেনা নেমেছে অর্ধেকের নিচে। এ অবস্থায় সদরঘাট থেকে ব্যবসা গুটিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন অনেক হকার। সদরঘাট সরেজমিনে কয়েকজন হকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় হকারি ছেড়ে অন্য কাজে জড়িত হচ্ছেন তারা। বেচাকেনার টানাপড়েনে স্বল্প আয়ে নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছেন হকাররা।
হকাররা জানান, পদ্মা সেতু হওয়ার পর সদরঘাটের পরিবেশ অনেকটা বদলে গেছে। আগে যেখানে ২০ থেকে ৩০টি লঞ্চ দৈনিক চলাচল করত, এখন সেখানে ৮-১০টি লঞ্চ চলে। যাত্রী সংকটে বেচাকেনা কমেছে। ফলে ধীরে ধীরে হকারের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে। নভেম্বর মাস থেকে হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার পর বেচাকেনা আরো কমেছে। এখন কোনোমতে দিন কাটছে তাদের। তবে অনেকে ব্যবসা ও জায়গা বদলের অন্যতম কারণ হিসেবে টার্মিনালে চাঁদাবাজিকেও দায়ী করে। হকারদের দাবি, লভ্যাংশের তিন ভাগের দুই ভাগই চলে যায় চাঁদা দিতে দিতে। ফলে দৈনিক যে আয় হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয় নিজের ও সংসারের খরচ বহন করতে।
সদরঘাট টার্মিনালে উপস্থিত হকাররা জানান, বেচাকেনা কম হওয়ায় টার্মিনাল থেকে অনেক হকার চলে গেছেন। অনেকে অন্য জায়গায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন। আগে পন্টুনের দুই পাশে হকারদের সরব অবস্থান থাকত। এখন যারা আছেন তারা কোনোভাবে এক পাশে বসে পণ্য বিক্রি করছেন। আগের সেই জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। একসময় যারা ফল বিক্রি করতেন, তারা ব্যবসা পরিবর্তন করে বাদাম, ঝালমুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছেন।
ফল বিক্রেতাদের ব্যবসা পরিবর্তনের কারণ হিসেবে জানা যায়, টার্মিনালে ঢোকার জন্য প্রত্যেক বিক্রেতাকে ফলের ঝুড়ির সাইজ অনুযায়ী ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এরপর পন্টুনের জায়গার ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া আনসার বাহিনীর সদস্যদের ১০০ টাকা ও স্থানীয় শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের ২০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিয়ে টার্মিনালে ফল বিক্রি করা অসম্ভব, অভিযোগ বিক্রেতাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লালকুঠি ঘাট সংলগ্নের একজন ফল বিক্রেতা জানান, সদরঘাটে সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয় ফল বিক্রেতাদের। যদি চাঁদা দিতে না হতো, তবে কেজিপ্রতি আরো ২০-৩০ টাকা কমে ফল বিক্রি করা যেত। মাসখানেক আগেও শুধু চাঁদপুর ঘাটে (চাঁদপুরে চলাচলকারী লঞ্চের পন্টুন) অন্তত ২০-২৫ জন ফল বিক্রেতা ছিল। এখন সেখানে হকার আছে ১০-১১ জন। বিক্রি হয় না যে তা কিন্তু না। তবে এই বিক্রি দিয়ে সংসার চালানো যায় না। সারা দিন ফল বিক্রি করে দুই হাজার টাকার মতো লাভ হয়। সেখান থেকে চাঁদার পেছনে চলে যায় ১০০০-১২০০ টাকার মতো। এরপর নিজের খরচ মিটিয়ে পকেটে টাকা থাকে না। এজন্য অনেক ফল বিক্রেতা অন্য কিছু বিক্রি করছেন। কারণ, অন্য ব্যবসায় চাঁদা দিতে হয় কম।
সদরঘাটে আমড়া ও পেয়ারা বিক্রিতা রবিউল হাসান (২৭) বলেন, দিনে যা ইনকাম হয় তা থেকে চাঁদার পেছনে চলে যায় ২০০ টাকা। প্রথমেই টার্মিনালের ভেতরে ঢুকতে দিতে হয় ৫০ টাকা, পন্টুনে বসার জন্য ১০০ টাকা, আনসারকে দিতে হয় ৫০ টাকা।
রবিউল হাসান বলেন, বেচাকেনা বেশি হলে চাঁদা দিতে সমস্যা হয় না। কিন্তু মানুষ নাই বেচাকেনা হবে কেমনে? যা আয় করি তার চেয়ে দৈনিক বেশি খরচ হয়। খরচ বাদ দিয়ে দিনে যদি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পকেটে না থাকে, তাহলে চলাটা কঠিন। এজন্যই অনেকে এখান থেকে ব্যবসা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছে।
টার্মিনালের পটুয়াখালী-বরিশাল ঘাটে চিপস, বিস্কুটসহ বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য বিক্রি করেন আজগর আলী (৪২)। পরিবারসহ থাকেন কেরানীগঞ্জে। পরিবার বলতে স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলেটিও টার্মিনালের হকার। মেয়েরা স্কুলে পড়াশোনা করছে। আজগর আলী জানান, মাসখানেক আগেও দৈনিক চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। দেড়-দুই হাজার টাকা বেচাকেনা করতেই কষ্ট হয়ে যায়। অল্প পুঁজির ব্যবসায় যে লাভ হয়, তাতে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে কষ্ট হয়। পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে কষ্ট হয়। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই ব্যবসা বদল করে যা পুঁজি আছে, তা দিয়ে শীতের কাপড় বিক্রি করব।
"