কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২৮ নভেম্বর, ২০২৩

চট্টগ্রামে টক অব দ্য টাউন নাছির-সুজন

‘আমি আপনাদের হয়ে থাকতে চাই। আপনাদের ভালোবাসায় আমি অভিভূত। আপনাদের প্রতি রইল আমার লাল সালাম।’ মনোনয়ন না পেয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব কথাগুলো লিখেছেন। অপরদিকে গণমাধ্যমের কাছে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেছেন, ‘নেত্রীর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, রাজনীতি একদিনের নয়, রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নেই।’

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতি মানেই নাছির-সুজন। এ দুজন মনোনয়ন পাবেন এমন নিশ্চিত একটা ধারণা সবার মধ্যে ছিল। দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ মনে করেছিলেন নগর আওয়ামী লীগের অতীতের ধারাবাহিকতায় দলের শীর্ষ স্থানীয়রাই মনোনয়ন পান। এ হিসেবে খোরশেদ আলম সুজন ও আ জ ম নাছিরও মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে তাদের নাম ছাড়াই মনোনয়ন ঘোষণা করা হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নেতাকর্মী সমর্থকদের মাঝে মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়টি ‘টক অব দ্য টাউন’ এ পরিণত হয়েছে।

নগরীর গুরুত্বপূর্ণ আসন বলে পরিচিত চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া), চট্টগ্রাম-১০ (পাঁচলাইশ-ডবলমুরিং) ও চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা)। এসব আসনে মনোনয়নের দিকে সবার নজর থাকে। কারণ চট্টগ্রামের এ আসন দুটি ওপর নির্ভর করে পুরো চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের রাজনীতি। বিশেষ করে নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমান আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ঘুরে ফিরে আলোচনায় থাকেন। নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধারক ও বাহক বলে পরিচিত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাবার পর তার সন্তান মহিবুল হাসান নওফেল মন্ত্রী হলেও আরো দুজন রাজনৈতিক নেতা চট্টগ্রামে দলকে ঘিরে ব্যাপক সক্রিয়।

তাদের একজন হলেন- নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, অপরজন হলেন- নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি সাবেক সিটি প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। এ দুজন দীর্ঘ বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলকে এ পর্যায়ে আনার পেছনে দুজনের ভূমিকাও নজরে পড়ার মতো। বাকি আসনগুলো নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা না থাকলেও নগরীর তিন আসনের ভবিষ্যৎ নৌকার কান্ডারি নিয়ে বরাবরই সরব থাকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি।

আগামী সংসদ নির্বাচনে আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম-৯, ১০ ও ১১ এ তিন আসনেই মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। চট্টগ্রাম-১০ ও চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে আ জ ম নাছিরের পাশাপাশি মনোনয়ন চেয়েছিলেন সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। কিন্ত মনোনয়ন ঘোষণায় দুজন সিনিয়র নেতাকে বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম-১০ আসনে সম্প্রতি উপনির্বাচনে জয়ী হওয়া মহিউদ্দিন বাচ্চু ও চট্টগ্রাম-১১ আসনে এম এ লতিফ এমপিকে পুনরায় মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর চট্টগ্রাম-৯ আসনে মহিউদ্দিন চৌধুরী পুত্র মহিবুল হাসান নওফেল মনোনয়ন পান।

নাছির ও সুজন কেন পেলেন না মনোনয়ন, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না দিলেও দুজনেরই ছিল অনেকটা একই বক্তব্য। তারা দুজনই বলেছেন, ‘নেত্রী যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’ তবে পরিস্থিতি বলছে অন্যকথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ দুজনের মনোনয়ন না পাওয়াকে ঘিরে চলছে ব্যাপক আলোচনা। বিশেষ করে খোরশেদ আলম সুজনের ফেসবুক পেজে মনোনয়ন না পাওয়াকে কেন্দ্র অনেককে নানা মন্তব্য দিতে দেখা যায়।

মোহাম্মদ ইয়াসিন নামের একজন লেখেন, ‘সুজন ভাই আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র হিসেবে আপনাকে মনোনীত করা হবে। এটা আমার দীর্ঘ বিশ্বাস। আপনি ছোট-বড় সবাইকে যেভাবে আপন করে নেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো তাতেই রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনার জীবনের মঙ্গল কামনা করি।’

জাহিদ আকবর নামে একজন লেখেন, ‘মেয়র পদে আপনাকে খুবই প্রয়োজন। প্রশাসক থাকার সময় আপনার কিছু কাজ খুবই প্রশংসনীয় ছিল’। সুরঞ্জিত দে শুভ নামের একজন লিখেছেন, ‘আমরা ছিলাম, আছি থাকব। আপনি চট্টলার গণমানুষের অন্তরে আছেন এবং থাকবেন। আপনি আমাদের মতো তৃণমূল কর্মীদের হৃদয়মনি হয়ে চিরকাল থাকবেন প্রিয় লিডার।’

মিজানুর রহমান মিজান নামের একজন লেখেন, ‘যিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের কাছে অন্তরের নেতা তার এমপি হওয়ার প্রয়োজন নেই। চট্টলার বীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এমপি ছিলেন না। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের কাছে হৃদয়ের নেতা ছিলেন। আপনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের কাছে অন্তরের নেতা হিসেবে অনেকদিন বেচেঁ থাকবেন।’

একইভাবে আ জ ম নাছিরের মনোনয়ন না পাওয়াকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে ব্যাপক আলোচনা। হুমায়ন কবির রিকু নামের একজন লিখেছেন, ‘আমরা সবাই আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাইয়ের অনুসারী, নৌকার প্রার্থী যেই হোক না কেন আমরা নৌকার, আমরা শেখ হাসিনার লোক’। রবিন দে নামের একজন লেখেন, ‘রাজনীতি যখন শুরু করেছিলাম তখন নাছির ভাইয়ের কোনো পদবী ছিল না, সারাজীবন ব্যক্তি আ জ ম নাছির উদ্দিন ভাইয়ের কর্মী হিসেবেই থাকতে চাই।’ সাবিদ রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের শহরের সব নেতা এক সিন্ডিকেট, অন্যদিকে আ জ ম নাছির উদ্দিন একক সিন্ডিকেট। দীর্ঘ ২৪ বছর উনাকে দাবিয়ে রেখেও উনি এ শহরের মেয়র হয়েছেন। সুতরাং উনি এসবে অভ্যস্ত। মনে রাখবেন আ জ ম নাছির উদ্দিন স্রোতের বিপরীতে রাজনীতি করতে বেশি পছন্দ করেন।’

বিভিন্ন সূত্র বলছে, এ দুজনের ঘনিষ্ট অনেকে চাননি তারা মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন। কারণ এ দুজনকে ঘিরে এক ধরনের জুজুর ভয় কাজ করে অনেকের মধ্যে। এদের অনেকে ওপরে ওপরে এ দুনেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখলেও ভেতরে সব ধরনের চেষ্টা চলে যাতে কোনো অবস্থাতেই এরা ক্ষমতা না পান। নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এম এ মান্নান ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাবার পর থেকে আ জ ম নাছির উদ্দিন ও খোরশেদ আলম সুজন নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির হাল ধরে আছেন। এ দুজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। আ জ ম নাছির নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র হবার পর নিজস্ব একটি বলয় সৃষ্টি করেন। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বেচেঁ থাকার সময় থেকে আ জ ম নাছির উদ্দিন কার্যত এ বি এম মহিউদ্দিন বিরোধী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন দলের সবকিছু। এখন পর্যন্ত সে ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছেন।

অপরদিকে খোরশেদ আলম সুজন ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারী ও ঘনিষ্ঠজন। মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে থাকাকালীন সুজন কখনো দলের ব্যাপারে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওপর নাক গলাননি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর খোরশেদ আলম সুজন তার জায়গায় দলের হাল ধরেন। কিন্ত আ জ ম নাছিরের সঙ্গে দূরত্ব থেকে যায়। খোরশেদ আলম সুজন ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান নওফেল একটা বলয়ের হলেও আ জ ম নাছির উদ্দিন স্বতন্ত্রভাবে নিজের অবস্থান থেকে সরেননি। নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দূরত্বের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।

আ জ ম নাছির উদ্দিন মেয়র হিসেবে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করার পর পরবর্তী সময়ে নেত্রী তাকে আর মনোনয়ন দেননি। এ নিয়ে বাজারে নানা রকম গুঞ্জন আছে। পরবর্তীতে নেত্রী চট্টগ্রামে এলে পলোগ্রাউন্ডের জনসমাবেশ সফল হওয়ার পর সবাই মনে করেছিলেন নাছির সামনের নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। অপরদিকে খোরশেদ আলম সুজনকে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ করার পর ৬ মাসে সুজন নগরবাসীর মন জয় করে নেন। মাঠে ময়দানে সক্রিয় থেকে নিজেকে মনোনয়নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সবাই মনে করেছিলেন, সুজনের মনোনয়নও নিশ্চিত। কিন্ত দুজনের কেউ মনোনয়ন পেলেন না। এ মনোনয়ন না পাওয়াকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মী সমর্থকরা বিস্মিত, হতবাক। অনেক নেতাকর্মী এদের স্বতন্ত্র নির্বাচন করার পরামর্শ দিলেও দুজনেই দলের ওপর আস্থাশীল হয়ে স্বতন্ত্র পথে এগোবেন না বলে জানা গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close