নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২২

রেলের কোনো প্রকল্পই সময় মেনে চলে না

মেরামতের ১৫ দিনেই ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট * ট্রেন আছে ৩৬১টি চলছে না ৯৯টিই * ১৪ বছরে গচ্চা ৭০,০০০ কোটি টাকা

১৪ বছরে সরকার রেলওয়ে খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকার চেয়েও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে ৩৬১টি ট্রেনের মধ্যে অন্তত ৯৯টি ট্রেনই চলছে না। যে ট্রেনগুলো চলছে না, তাদের বেশির ভাগই লোকাল, মেইল অথবা যাত্রীবাহী ট্রেন। এই ট্রেনগুলোর ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের মানুষ ও স্বল্প দূরত্বে ভ্রমণকারীরা এগুলোতে চড়তেন। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জনবল ও কোচ পাওয়া সাপেক্ষে কয়েকটি ট্রেনের কার্যক্রম আবার শুরু করা হবে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় এই ট্রেনগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। সূত্র জানিয়েছে, কিছু ট্রেন গত দশক থেকেই চলছে না। এই ট্রেনগুলো আর কখনো চালু করা সম্ভব হবে না।

এদিকে, আরো উন্নত পরিষেবা দিতে বাংলাদেশে রেলওয়ের ৩৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু, এগুলোর কোনোটিই যথাসময়ে শেষ হবে না। ফলে একসঙ্গে এতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাংলাদেশ রেলওয়ের আছে কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে ২৫টি প্রকল্পের সময়সীমা ১ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যার মধ্যে ১১টির ব্যয়ও বেড়েছে এবং একটি প্রকল্পের ব্যয় ৮৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

৩৫টি প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ২০ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধনের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ২৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ রেলওয়েকে আরো ৩২ হাজার ৮ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করতে হবে, যা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের চেয়েও বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

তবে যদিও বাকি ১০টি প্রকল্পের সময়সীমা এখনো শেষ হয়নি, তবে সেগুলোর একটির কাজই এখনো শুরু হয়নি। ফলে সেগুলোর সময়সীমাও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে প্রকল্পলোতে ব্যয়ও বাড়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ, সময়সীমা বাড়লে সাধারণত প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব হলে জনসাধারণের অর্থও বেশি ব্যয় হয়। প্রকল্পগুলোতে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই বিদেশি ঋণ। অন্যদিকে, উন্নত রেল পরিষেবার জন্য মানুষের অপেক্ষাও আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

সর্বোপরি কয়েক দশক ধরে অবহেলিত রেলপথকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকারের যে পরিকল্পনা, তা হোঁচট খেয়েছে। যদিও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য ৭১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা এই খাতে ব্যয় করেছে।

অন্যদিকে, দেশীয় পদ্ধতিতে, সাশ্রয়ী মূল্যে অচল ডেমু ট্রেন মেরামত করে সচল করার ১৫ দিনের মাথায় ডেমু ট্রেনের দুটি ইঞ্জিনের একটি বিকল হয়ে পড়েছে। এখন একটি ইঞ্জিন দিয়ে কোনো রকমে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার গতিতে ডেমু চালানো হচ্ছে। ফলে ডেমু ট্রেন সময় মেনে চলতে পারছে না। এতে যাত্রী ও আয় কোনোটাই আশানুরূপ হচ্ছে না। রেলওয়ে সূত্র বলছে, ট্রেনটি চালিয়ে গড়ে যে আয় হচ্ছে, তাতে জ্বালানি খরচই উঠছে না।

অচল ডেমু ট্রেন সচল করতে মো. আসাদুজ্জামান নামে এক প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেয় রেলওয়ের মেকানিক্যাল বিভাগ। তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে চাকরি করেন। গত ২ বছর ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ করে এক সেট ডেমু ট্রেন সচল করা হয়।

গত ৯ অক্টোবর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত পথে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ট্রেনের চলাচল উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রীসহ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ডেমু ট্রেনটি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চালানো হচ্ছে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, উদ্বোধনের পর কিছুদিন ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে ডেমু ট্রেন চলেছে। গত ২৫ অক্টোবর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এখনো সেটি বিকল আছে। ডেমু ট্রেনের দুই পাশে দুটি ইঞ্জিন। এখন একটি ইঞ্জিন দিয়েই চলছে। গতি ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার। ট্রেনটি দিনে একবার রংপুর গিয়ে আবার পার্বতীপুরে ফিরে আসে। অর্থাৎ দিনে দুবার চলাচল করে।

রেলওয়ে সূত্র আরো বলেছে, ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ডেমু ট্রেনটি মোটামুটি সময় মেনেই চলাচল করেছে। একটি ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর ২৫ অক্টোবর পার্বতীপুর থেকে ৫৫ মিনিট দেরিতে ছাড়ে। রংপুর পৌঁছে ফেরার সময় এক ঘণ্টার বেশি দেরি করে। এরপর প্রতিদিনই আসা-যাওয়ায় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি দেরি করছে। ডেমু ট্রেনটির যাত্রী মূলত স্বল্প দূরত্বের। তাদের বেশির ভাগই অফিসগামী। কেউ কেউ জরুরি কাজে যাতায়াত করেন। সময় মেনে চলছে না বলেবাংলাদেশ রেলওয়ের ৩ হাজার ৯৩ কিলোমিটারের নেটওয়ার্ক দুটি জোনে বিভক্ত। ৩৬১টি ট্রেনের মধ্যে ১৯২টি পূর্ব জোনে এবং ১৬৯টি পশ্চিম জোনে চলাচল করে থাকে।

৯৯টি অকার্যকর ট্রেনের (ট্রেনের ২৭ দশমিক ৪২ শতাংশ) মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম জোনে আছে যথাক্রমে ৫৬ ও ৪৩টি। এর মধ্যে ৫৭টি লোকাল ট্রেন ও ১২টি মেইল ট্রেন। এ ছাড়া পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের কাজে সুবিধার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল স্থগিত রেখেছে। কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার আগে এই রুটে ৮ জোড়া লোকাল ট্রেন ও ১ জোড়া ডেমু ট্রেন চলাচল করত।

বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০১৭-১৮ সালে ১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা আয় করেছে। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ সালে তা কমে যথাক্রমে ১ হাজার ১৯৯ কোটি ও ১ হাজার ১৬৬ কোটিতে পৌঁছায়।

২০২১-২২ সালে ট্রেনের কার্যক্রম মোটামুটি স্বাভাবিকপর্যায়ে থাকলেও সংস্থাটির আয় করোনা মহামারির আগের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সে বছরে আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close