বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪

পুরান ঢাকার অলিগলির ‘খেতা পুরি’

খেতা পুরি! এ কেমন নাম! এর সঙ্গে কাঁথার কি কোনো যোগসূত্র আছে বা এ নামই এলো কেমন করে? এমন ভাবনা মাথায় নিয়ে পুরান ঢাকার লালবাগের চৌধুরী বাজার মোড়ে গড়ে ওঠা এক ঐতিহ্যবাহী খেতা পুরির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বড় তাওয়ার ওপর বেশ পুরুত্বওয়ালা পুরি হালকা তেলে ভাজা হচ্ছে, নাকে এসে লাগছে তার সুঘ্রাণ। পুরি বিক্রেতা চাচা তার হাতের জাদুতে দ্রুতলয়ে পুরি ভাজতে ভাজতে জানালেন, খেতা পুরির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, অন্যান্য পুরিতে আটা ব্যবহার করলেও এটা বানাতে ময়দা ব্যবহার করা হয়। ময়দার ডো থেকে ছোট ছোট রুটি বেলে তৈরি করা হয়। এভাবে অনেক রুটি তৈরি হলে একটি রুটির ওপর ডাল ঠেসে দিয়ে তার ওপর আরেকটি রুটির টুকরো দিয়ে আবার রুটি বানানো হয়। রুটির পুরুত্ব বেশ মোটা হয়। বুট, খেসারি বা মশুর ডালের সঙ্গে পুদিনা পাতা, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ কুচি, আদা-পেঁয়াজ-রসুন বাটা ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে মিশ্রণ বানানো হয়, যা মূলত খেতা পুরির পুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পুর যত ভালো হবে, খেতা পুরি তত মজা হবে। এরপর হালকা তেলে তাওয়ায় ভেজে তৈরি করা হয় খেতা পুরি।

কথা প্রসঙ্গে আরো জানা গেল, অনেক জায়গায় খেতা পুরি না ভেজে শুধু তাওয়ায় সেঁকে পরিবেশন করা হয়। যারা তেলে ভাজা খাবার পচ্ছন্দ করে না, তাদের জন্য এটি বেশ উপাদেয়। তাই অনেকে একে ডাল রুটি বলে থাকেন। গড়ে চার থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগে একে গরম করতে। এর দুই পিঠে একটু সেঁক লাগলেই সরিয়ে রাখা হয় তাওয়ার মাঝের গরম অংশ থেকে, মানে এটি ততক্ষণে বিক্রয়ের জন্য তৈরি। এটি গরম গরম খেতে আসলেই অসাধারণ লাগে। খাওয়ার জন্য খেতা পুরির সঙ্গে দেওয়া হয় পুদিনা-ধনে-লেবু-তেঁতুলের চাটনিসহ বিভিন্ন রকম ভর্তা।

ঠিক কখন থেকে খেতা পুরির প্রচলন শুরু হয়েছে বা নামটাই কীভাবে এসেছে এ বিষয়ে অনেককে জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পেলাম না। বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বললেও বেশ বয়স্কমতো একজন বিক্রেতা বললেন, খেতা পুরির প্রচলন শুরু হয়েছে খুব সম্ভবত পাকিস্তান আমল থেকে। তবে এটি মূলত ওড়িশা, বিহার অঞ্চল থেকে এসে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অনেকটা অর্থনৈতিক কারণে এই খাবারের উদ্ভব। যেহেতু খুবই সহজলভ্য উপাদানে তৈরি, তাই এটি অল্প খরচে প্রয়োজনীয় শর্করা এবং আমিষের অভাব পূরণ করে। তবে তৎকালীন ঢাকার ধনী শ্রেণির লোকরা খেতা পুরি খাসি, গরু, মুরগির মাংসের সঙ্গে খেতেন। পুরান ঢাকার অলিগলিতে হাঁটার সময় খেতা পুরির দোকান চোখে পড়বেই। দেখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও এসব দোকান বেশ ঐতিহ্যবাহী। অতি সাধারণ এসব দোকানের খেতা পুরি কিন্তু যুগ যুগ ধরে সুনামের সঙ্গে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কয়েক পুরুষ ধরে কারিগররা বেশ আগ্রহ নিয়ে এই পুরি বানিয়ে আসছেন। এসব দোকানের খেতা পুরির স্বাদও অসাধারণ। তাই পুরান ঢাকার খেতা পুরির ঘ্রাণ একবার নাকে গেলে স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা দমন করা কঠিন। এসব দোকানে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু করে রাত নয়টা পর্যন্ত চলে খেতা পুরি বিক্রি। আকার ও দোকানভেদে প্রতিটি খেতা পুরির মূল্য তিন বা পাঁচ বা দশ টাকা। প্রতিদিন বিকেলে প্রতিটি দোকানে গড়ে তিন থেকে চার শ খেতা পুরি বিক্রি হয়। বিকেল বা সন্ধ্যার নাশতায় অনেকেই পুরি পছন্দ করেন। তাই পুরিপ্রেমীদের রসনা মেটাতে পুরান ঢাকার খেতা পুরির জুড়ি মেলা ভার। আর তাই তো খেতা পুরি খেতে স্থানীয় লোকজনসহ আশপাশের অনেকেই প্রতিদিন ভিড় জমান পুরান ঢাকার অলিগলিতে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close