reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

নলছিটিতে জ্যোতি ছড়াচ্ছে ‘তারুণ্যের নলছিটি’

‘তরুণ’ তারুণ্যের দীপ্তিময় এক শক্তির নাম। তারুণ্য একটি উদ্দীপনার নাম, অদম্য শক্তি, অপ্রতিরোধ্য ঝড়, দৃপ্ত শপথ, দুর্জেয় ঘাঁটি ও বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। সব বাধা ছিন্ন করে সম্মুখপানে এগিয়ে চলাই তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য। তারুণ্যের অপর নাম অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও সৃষ্টির উন্মাদনা। তারুণ্যের বিকাশের মাধ্যমে তরুণদের আত্মোন্নয়ন ও মানবিক কাজে মফস্বল শহর নলছিটিতে আলোর জ্যোতি ছড়িয়ে যাচ্ছে তারুণ্যের নলছিটি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন। নিজ জন্মস্থানের প্রতি ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতার চেতনা থেকে নলছিটির একঝাঁক মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের সঙ্গে নিয়ে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়ে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন মো. খালেদ সাইফুল্লাহ। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ কনভেনর, কো-কনভেনর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুব তালুকদার ও আরাফাত হোসেন এবং বাংলাদেশ প্রোফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিইউপি) তামজীদ হাসান তাহমিদ। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসমান গনি রেসানী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সোলাইমান কবির শান্ত। তাদের হাত ধরে হাঁটিহাঁটি পা-পা করে বর্তমানে তারুণ্যের নলছিটির ভলান্টিয়ার শতাধিক। বিগত তিন বছরে অর্ধশত ইভেন্ট আয়োজন করে তারুণ্যের নলছিটি। সরাসরি উপকৃত হয়েছে প্রায় এক হাজার মানুষ, সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছে উপজেলার সহস্রাধিক নাগরিকের মধ্যে। এই সংগঠনে যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে তারা সবাই নলছিটি উপজেলার সন্তান, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। উপজেলায় সামাজিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননাও অর্জন করেছে সংগঠনটি।

করোনাকালীন ভূমিকা : বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে পুরো দেশ যখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল, যখন মানুষ সংক্রমণের ভয়ে আপন মানুষকে ত্যাগ করছিল, তখন জীবন ঝুঁকি নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি অভিযান, প্রতিরোধে বিভিন্ন কিডস বিতরণ ও অক্সিজেন সেবায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছে তারুণ্যের নলছিটি ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের সদস্যরা। সুবিধাবঞ্চিতদের ভ্যাকসিন নিবন্ধনের হয়রানি মুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রি ভ্যাকসিন নিবন্ধন বুথ, যা উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুম্পা সিকদার। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে লিফলেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মতৎপর ভূমিকা। প্রান্তিক পর্যায়ে ইউনিয়ন, গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের দোরগোড়ায় গিয়ে সচেতনতার বার্তা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাক্স ইত্যাদি সামগ্রী বিতরণ করেন।

উপজেলা পৌরসভা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ব্যাপ্তি : বর্তমান তরুণসমাজকে নিয়ে এখন সুশীল সমাজ সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। এখনকার তরুণরা উদ্বেগজনক হারে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে নানা ধরনের অপরাধে হরহামেশাই নিজেকে জড়িত করে ফেলছে। নিজেকে বিপথগামী করার পাশাপাশি সমাজের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারুণ্যের নলছিটি সুশীল সমাজকে বার্তা দিচ্ছে- হুমকি নয় সম্ভাবনাই হচ্ছে এ জনপদের তরুণরা। আমাদের সমাজে এখন অহরহ বিভিন্ন সংগঠন চোখে পড়ে। গতানুগতিক সংগঠনের মতো নয় এই ‘তারুণ্যের নলছিটি’। ‘তারুণ্যের নলছিটি’ এ সংগঠনে আছে নিজস্ব স্বকীয়তা, যা এই সংগঠনকে অন্য সংগঠনগুলো থেকে ইউনিক করে রেখেছে। মূলত সদস্যদের মেধা, মনন ও চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করাই এর প্রধান লক্ষ্য। কাজের পরিধি পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ইউনিয়নের গ্রাম পর্যন্ত।

তরুণদের আত্মোন্নয়নে ভূমিকা : সংগঠনের সদস্যদের বিভিন্ন সফট স্কিল ডেভেলপ ও তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের লক্ষ্য নেওয়া হয় নানা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ। সিভি রাইটিং, বিতর্ক প্রশিক্ষণ ও বিতর্ক আয়োজন, পাঠচক্র, সাহিত্য আড্ডা, বক্তব্য প্রদানের নানা কলাকৌশল, লিডারশিপ, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, মোবাইল গ্রাফিকস কোর্স ইত্যাদি। প্রশিক্ষণগুলোর মাধ্যমে তরুণরা নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে পারে। এসব ট্রেনিং থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ভবিষ্যতে পেশাগত কাজেও সহযোগিতা করবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে ক্যাম্পেইন, বিতর্ক প্রশিক্ষণ, নলছিটি অলিম্পিয়াড, কুইজ ও লেখালেখি প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ইভেন্ট এ জনপদের তরুণদের আত্মোন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে তারুণ্যের নলছিটি।

পাঠাগার ও ম্যাগাজিন : নলছিটির তরুণদের মেধাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে ২০২১ সালে কমিউনিটিভিত্তিক পাঠাগার সেবার কার্যক্রম শুরু করে তারুণ্যের নলছিটি। শুধু বই পড়ার সুযোগ নয় এ জনপদের তরুণদের সৃজনশীল লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করতে ‘তারুণ্যের দর্পণ’ নামে ম্যাগাজিনও এক বছর ধরে নিয়মিত ই-ভার্সন প্রকাশিত করছে, যার স্লোগান হলো ‘লেখনীর ধারায় উদ্ভাসিত হোক নলছিটির তরুণদের প্রতিভা’। আধুনিক ডিভাইসের শিকলবন্দি তরুণদের বইমুখী করে এবং নতুন লেখক গরনের কারিগরি হিসেবে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে এ সংগঠনটি। এই ম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করছেন তারুণ্যের নলছিটি দুজন চৌকস দক্ষ ও অভিজ্ঞ ভলান্টিয়ার।

মানবিক কাজ : দূরারোগ্যে আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসা সহায়তা তহবিল সংগ্রহ করে তারুণ্যের নলছিটি। প্রতিবছর এ তহবিল থেকে রোগীদের পাশে দাঁড়ানো হয়। সর্বশেষ ক্যানসার আক্রান্ত দুজন রোগীর পাশে দাঁড়ায় এই সংগঠন। সংগঠনটির সদস্যরা নিজেরাও রক্তদান করছেন নিয়মিত। রক্তদানে উৎসাহিত করতে রক্তদাতাদের গল্প তুলে ধরা হয় ও পুরস্কৃত করা হয়। ‘রক্তদানের গল্প’ প্রতিযোগিতার আয়োজনে ‘মাহেদী হাসান’ নামে এক রক্তদাতা লিখেছিলেন ‘প্রথমবার রক্তদান করে পরের ৪ মাস পূর্ণ হলেই রক্তদানের জন্য এখন প্রস্তত থাকি। ষষ্ঠবারের ব্লাড দেওয়ার গল্প বলছি। আমার বাড়ি নলছিটি, রক্তদানের স্থান ছিল স্বরূপকাঠি, যা আমার বাসা থেকে প্রায় ৩৫ কিলো দূরে। বেলা ১১টায় সেখানে গিয়ে পৌঁছানো হলো। ব্লাড টানার পূর্বের সকল পদক্ষেপ শেষ হলে যখন ব্লাড নেবে, তখন ডায়াগনস্টিকের কর্তৃপক্ষ রোজা আছি জেনে ব্লাড নেবে না, তাই বলা হলো। যদি রোজা ভাঙা হয় তাহলে ব্লাড নেবে। আমি তারপরও অনেক জোর করছিলাম, তাই সেখানের ডাক্তারকে জানানো হলে এবং ডাক্তার আমাকে না বলে দেল। যেকোনোভাবেই এখন নেওয়া সম্ভব না। আর আমারও কোনোভাবেই রোজা ভাঙতে ইচ্ছে হলো না। তাই ২-৩ ঘণ্টা সিদ্ধান্তহীনতায় কাটালাম রোজা ভাঙব নাকি সন্ধ্যার পরে দেব। সবকিছু বিবেচনা করে দেখলাম সন্ধ্যার পরে ব্লাড দিয়ে বাসায় যেতে আমার ও রোগীদের দুজনেরই সমস্যা হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম রোজা না ভেঙেই দেব এবং তাদের বিষয়টি জানাব রোজা ভাঙা হয়েছে। যেই ভাবা সেই কাজ। অবশেষে বিকেল ৫টায় তাই করা হলো। আমার রোজাও ছিল, ব্লাডও দেওয়া হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্থই ছিলাম।’ দুর্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, শীতার্ত মানুষের কাছে শীতবস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, সমতার ইফতার, ঈদে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানো ও অসহায়ত্ব রোগীকে আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা মানবিক কাজে সক্রিয় তারুণ্যের নলছিটি।

নলছিটির তরুণদের নিয়ে পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন তারুণ্যের নলছিটি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন। নলছিটির বুকে ‘তারুণ্যের নলছিটি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাংগঠনিক কাঠামো ও নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে জ্ঞান-মেধা-মননচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ব্যতিক্রমী এ সংগঠন তার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সব সদস্যকে তাদের পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি নিজেদের আত্মিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং ভলান্টিয়ারদের জ্ঞান, মেধা, উদ্যমী এবং সম্ভাবনাময় করে গড়ে তুলছে। নিজেদের আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি তারুণ্যের অগ্রযাত্রায় অগ্রণী ভূমিকার জন্য প্রতিবছর ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালে অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন মো. মেহেরাব হোসেন রিফাত, ২০২১ সালে মো. রাব্বি খলিফা এবং ২০২২ সালে মো. আরিফুল ইসলাম আকাশ। তারুণ্যের নলছিটি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন দক্ষ যুবসমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। দেশের বুকে নলছিটিকে ব্যান্ডিং করতে ও আগামীর নলছিটি বিনির্মাণে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে নজিরবিহীন ভূমিকা রাখছে। মফস্বল শহর নলছিটিতে জ্যোতি ছড়ানো অব্যাহত থাকুক।

আরিফুল ইসলাম আকাশ

শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

নলছিটি, ঝালকাঠি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close