মামুন মিসবাহ

  ২৭ নভেম্বর, ২০২৩

ক্যাম্পাসপ্রেমের বর্ণিল উপাখ্যান

জীবন অতিবাহিত হয় জীবনের মতো। কখনো এখানে, কখনো ওখানে। আর জীবনের গল্পগুলো এভাবেই স্থানান্তর হতে থাকে। কখনো এক জায়গা জুড়ে তা গড়ে ওঠে না। সময়, সুবিধা বা প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন হতেই থাকে। তাই প্রতিবার পরিবর্তনে প্রিয় মানুষের মতো প্রিয় স্থানগুলোও জায়গা করে নেয় হৃদয়ে। যেখানে সময় কাটাতে ভালো লাগে। নিজের পদচারণা যেখানে ভাবতে শেখায়। স্বপ্ন দেখতে শেখায়। গল্পগুলো নতুন ধারায় গাঁথতে শেখায়। হিমুর ময়ূরাক্ষী নদীর মতো আমার কোনো নদী ছিল না ঠিকই, কিন্তু ছিল- শৈশবে মায়ায় জড়ানো বড় ফুফুদের বাড়ির পাশের সেই উপ-নদীর পাড়। পাড়ের একপাশে ছোট্ট বাঁশঝাড়। ছায়ায় বসে বাতাসে গা ভাসানো। কিযে মধুর লগ্ন! ভগ্ন হৃদয়ে কল্পনা-জল্পনার সব রেশ কাটিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেত সুখময় স্বস্তির ভুবনে। কী করে ভুলি কৈশোরে প্রিয় হয়ে ওঠা বাড়ির অদূরের পিটিআই মাঠ! বাড়িতে থাকলে সেখানেই কেটে যায় দিনের পুরোটা সময়। অথবা ঢাকার কেরানীগঞ্জের মিকাইলনগরের সেই পিচঢালা উঁচু পথ। দুপাশে গাছ। বৈকালিক পরিবেশে বন্ধুদের নিয়ে হাঁটাচলায় কিযে আনন্দ! কিংবা মাদরাসার পুকুর পাড়ের সেই চিরচেনা ঘাটলা। যেখানে বসে আড্ডা জমত খুব! এমন বহু জায়গা হৃদয়মাঝে এখনো রয়েছে স্মৃতি হয়ে, যা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তেমনই এক প্রিয় জায়গা ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ক্যাম্পাস’। উনিশ সালের শেষের দিকে যেখানে শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়, ক্যাম্পাস লাইফ। এখনোবধি যেখানে জীবনের কিসসাগুলো স্বরচিত সংগীত গেয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছে নতুন দিনের।

এক.

কিছুটা নিদ্রামগ্ন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। রাত তখন শেষ প্রহরে। বাস এসে থামল ক্যাম্পাস গেটের ঠিক সামনে। হেল্পারের উচ্চ স্বরে ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস ডাক শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। দ্রুত ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে পড়লাম। বাস চলে যেতেই দুচোখের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছ। ডাল-পালা মেলে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। যেন আমার দিকেই তাকিয়ে। মনে হচ্ছিল লাল ফুল ছিটিয়ে নীরব মনে আওয়াজীনভাবে বলছিল- ‘ওহে নবীন! স্বাগত জানাই ইবির ১৭৫ একরে। এখন থেকে তুমি ইবি পরিবারেরই একজন। পুরো ক্যাম্পাস তোমার। আগলে রেখো নিজের মতো করে। তোমার কারণে যেন ইবি গর্বিত হয়। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বিশ্বের দরবারে। শুভকামনা তোমার জন্য।’ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাস্তা পার হয়ে মেইন গেটকে ছাউনি বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন দাঁড়ানো। ভেতরে তাকাতেই মুজিব ম্যুরাল সামনে। তখন অবশ্য জানা ছিল না সেই জায়গার নাম। বৃষ্টি একটু কমতেই ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। যেতে হবে সাদ্দাম হল। পরীক্ষার সময় একবার এসেছিলাম। কিন্তু মনে নেই, কোনদিকে রাস্তা! একজনকে জিজ্ঞাসা করে ডায়না চত্বরের রোড ধরে সাদ্দাম হলের দিকে এগিয়ে গেলাম। এই রাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে হাঁটতে কিন্তু দারুণ লাগছিল। তবে সবকিছু নতুন হওয়ায় অজানা ভয়ও ছিল অন্তরে। অডিটোরিয়াম পার হতেই সাদ্দাম হল দেখা গেল। মনের মধ্যে একটু হলেও সাহসের সঞ্চার হলো। কারণ, ক্যাম্পাসের আর কিছু না চিনলেও এই সাদ্দাম হল ভালোভাবেই চেনা। পরীক্ষা ও ভর্তির সময় ওখানেই ছিলাম। শিব্বির ভাইয়ের রুমে। এবারও গন্তব্য তারই রুম। ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগ নিয়ে সাদ্দাম হলের ভেতরে ঢুকে গেলাম।

দুই.

প্রথম কয়েক দিন খুবই বিষণ্ণ ছিলাম। খুব একটা পরিচিতি নেই। তার ওপর সবকিছু নতুন লাগছিল। একটা মেসে উঠে পড়েছি। ডিপার্টমেন্টের দু-একজন ছাড়া কাউকে তেমন চিনি না। ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা হয়েছে দু-একবার। বঙ্গবন্ধু হল থেকে শুরু করে মসজিদ রোড, এরপর লেক ও প্যারাডাইস রোড। কিন্তু কোনোটার নাম ছিল না মুখস্থ। বিকেলবেলা এসব জায়গা ঘুরে দেখার আনন্দ অন্যরকম। প্রত্যেকটা জায়গা জুড়ে ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতা মিলছিল, যা মনে রাখার মতো। তবে একাকিত্ব আমাকে তখন ভালো করেই পেয়ে বসে। ক্যাম্পাসের চেয়ে মেসে সময় কাটাতে ভালো লাগত। এটার একমাত্র কারণ হিসেবে দেখতাম কম জানাশোনা। বন্ধুবান্ধব সীমিত। এমনটা হওয়ার কারণও ছিল যথেষ্ট। ক্লাস শুরু হওয়ার দেড় মাস পর জয়েন হয়েছিলাম। এক সপ্তাহ ক্লাস করতেই করোনার হানা। সব মিলিয়ে দীর্ঘ একটা সময় বাদ ক্যাম্পাসে ফেরা। আমি এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। সফলও হলাম। বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরা বাড়ানো, সামাজিক সংগঠনে অ্যাকটিভিটি আমাকে খুব সুবিধা দিল। আমি দ্রুতই একাকিত্ব কাটিয়ে উঠলাম। আর অধিক পরিমাণে ক্যাম্পাসে সময় কাটাতে লাগলাম। তাই ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসপ্রেম আমার হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। ক্যাম্পাসের প্রিয় কিছু জায়গা নিয়ে আমার জমানো অনুভূতি-

ডায়না চত্বর

ইবির প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে গেলেই প্রশাসনিক ভবনের ঠিক সামনেই পড়ে একটা চত্বর। প্রিন্সেস ডায়না যে বছর মারা যান, সে বছরই তার নামানুসারে চত্বরটির নাম হয় ‘ডায়না চত্বর’। ইবির শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত জায়গা ও পছন্দের জায়গা হলো এটি। সারি সারি সোনালু গাছ ও আলবেজিয়াছ গাছের শামিয়ানার বিস্তৃত সীমানা জুড়ে শিক্ষার্থীদের আড্ডা ও দক্ষিণা হাওয়ায় গা ভাসানো; ডায়না চত্বর যেন প্রাণবন্ত হয়ে থাকে। ক্লাসের ফাঁকে, গাড়ির অপেক্ষায়, গ্রুপস্টাডি; বৈকালিক পরিবেশে বন্ধু মহলের আড্ডা বা রাতজাগা খুনসুটিমুখর শত গল্পের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই চত্বর। সেখানে গেলেই অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে। মন খারাপের দিনে মন ভালো হয়ে যায়। বিষাদ ও হতাশার বিষ যেন সেখানে গেলেই পানি হয়ে আবার নতুন করে জাগতে শেখায়। এ যেন উদাসীন হৃদয়ের খোরাক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

বটতলা

ডায়না চত্বরের পরে শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত জায়গা হলো এই বটতলা। নয়টা থেকেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনা শুরু হয় তাতে। ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা তো খুবই কমন। গাছের চারপাশে বসে হাসি-তামাশা, সংগীত গাওয়া, বই পড়া সবই হয় তাতে। অনুষদ ভবনের পাশে হওয়ায় আমার তো ওখানেই সময় কাটত বেশি। কেননা আমার ক্লাসরুম ছিল অনুষদ ভবনেই। অবসর সময় বা ক্লাসের ফাঁকে একটু সুযোগ পেলেই বটতলায় আড্ডা দিতে চলে আসতাম। দারুণ লাগে বটের ছায়ায় নিজেকে উজ্জ্বল দেখতে।

মফিজ লেক

লেকের নামকরণ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে জায়গাটা অতি সুন্দর। খোলামেলা। নিরিবিলি। মানুষ নগণ্য থাকলে আরো ভালো লাগে। আমার সব সময় যাওয়া হতো রাতে। এক বড় ভাই ডেকে নিয়ে যেতেন। তখন থেকে তা আদতে পূর্ণ হয়। এখনো রাতে ঘুরতে বের হলে মফিজ লেকে অবশ্যই একবার যাওয়া হয়। ভালো লাগে। শীতকালে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে রাতের লেক উপভোগ করেছি, গরমের দিনে রাতের বাতাসের ঝাপটায় নিজেকে অন্যরকম জ্ঞান করেছি। অনুভূতির আয়নায় লেকের পাড় চমৎকার থেকেও অতি চমৎকার। তাকালেই হাজারো স্মৃতি ভেসে ওঠে অবয়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close