reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৩ অক্টোবর, ২০২৩

অ্যাপস বানিয়ে লাখপতি ফরহাদ

খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যান। সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে চাপে। ইউটিউব, গুগল ভিডিও হয় তার কাজ শেখার মাধ্যম। রাত বা দিন নেই। প্রোগ্রামিং, অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট নিয়ে পড়ে থাকেন। একসময় সফলতার দেখা পান। এখন তিনি একজন সফল অ্যাপস ডেভেলপার। একশোটিরও বেশি অ্যাপস নিয়ে কাজ করেছেন। মাসিক গড় আয় ছাড়িয়ে গেছে লাখ টাকা। একটি অ্যাপস বানিয়ে পাঁচ লাখ টাকাও আয় করেছেন। সফল এই তরুণ অ্যাপস ডেভেলপারের নাম রায়হান উদ্দিন ফরহাদ। তাকে নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

শুরু যেভাবে

তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন। বাবা না ফেরার দেশে চলে যান। মা ছোট একটা চাকরি করেন। সংসারে অভাব-অনটনের শেষ নেই। তিনি তখন টিউশনি শুরু করেন। পার্টটাইম জবও করেন কিছুদিন। তবে কোনোটাই ঠিক চাহিদার সঙ্গে যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে ইউটিউব-গুগলে কাজ খোঁজা শুরু করেন। প্রোগ্রামিংয়ের কাজ তার পছন্দ হয়। পাইথন প্রোগ্রামিংটা শিখে অ্যাপস ডেভেলপমেন্টে হাত দেন। রায়হান বলেন, কাজ শেখার জন্য, দক্ষতা অর্জনের জন্য রাত-দিন কম্পিউটারে পড়ে থাকতাম। অনেক কষ্টে কম্পিউটার কিনেছিলাম। একসময় অনেকগুলো বিষয় শিখে ফেলি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মা, ভাই, বোনকে নিয়ে ঢাকার মিরপুরে থাকেন তিনি।

খুলেছেন কোম্পানি

প্রথমদিকে রায়হান ফ্রিল্যান্সিং বেশি করতেন। বর্তমানে একটা অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানিতে রিমোট জব করেন। বাসায় বসে অফিস করা, বাসায় বসেই ক্লাইয়েন্টের সঙ্গে মিটিং করা। বলতে গেলে বাসাটাই একটা অফিস। এটাই হলো রিমোট জব বা ওয়ার্ক ফর হোম। বন্ধুদের নিয়ে খুলেছেন ‘Programmia’। এটা মূলত কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারদের টিম মিলে তৈরি করা। এখানে ফরহাদ ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। বলা যায়, শূন্য থেকে ফরহাদ লাখপতি হয়েছেন। যখন তার বাবা মারা যান, তখন তেমন কিছুই ছিল না। যাতে পরিবারটি চলতে পারে। মায়ের সামান্য ইনকামে সংসার টেনেটুনে চলত। নিজ চেষ্টা, অধ্যবসায়, সৃজনশীলতায় পরিস্থিতি বদলে দিয়েছেন ফরহাদ। নিজের আয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মাসিক আয় দিয়ে পরিবারের সব খরচ মিটে যায়। মা এখন আর চাকরি করেন না। বোনকে বিয়ে দিয়েছি। বাড়িও করেছি নিজের উপার্জিত টাকায়।’ মাসে গড়ে তার আয় লাখ টাকার বেশি। উপার্জিত আয়ে তিনি সন্তুষ্ট বলে জানান।

বহুমুখী কাজ

তিনি একজন সফল প্রফেশনাল পাইথন ডেভেলপার। ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের ব্যাকেন্ডের যাবতীয় প্রোগ্রামাটিক্যাল কাজগুলো করেন।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যহলো ফুড ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস, অফিস ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস, ভিপিএন, ক্যালকুলেটর ও ব্লগিং সফটওয়্যার ইত্যাদি। ফরহাদ বলেন, ‘অ্যাপস তৈরির পারিশ্রমিক হিসেবে বিশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেছি।’

সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে তার কাজের অভিজ্ঞতা দুই বছরের। আর ২০১৭ সাল থেকে পাইথন নিয়ে কাজ করছেন পেশা হিসেবে। ফরহাদ বলেন, ‘অনেকটা কৌতূহল, প্রয়োজনের তাগিদে প্রোগ্রামিং বেছে নিয়েছিলাম। তখন ভাবিনি যে এটা পেশা হিসেবে এত চমৎকার হবে। প্রোগ্রামাটিক্যাল কাজগুলো করে তিনি অন্যরকম আনন্দ লাভ করেন। তার মতে, ব্যাকেন্ডে কাজগুলো করে ইউজারকে ম্যাজিক দেখানোর থেকে বড় ভালো লাগা আর কিছুই হতে পারে না। ফরহাদ মূলত অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস ডেভেলপার। তিনি অ্যাপসটি বানানোর পর একজন IOS ডেভেলপারের কাছে Pass করেন। তিনি ঠিক সেম অ্যাপস বানিয়ে Apple store-এ পাবলিশ করেন। তার বানানো অ্যাপস সব ফোনে ব্যবহার করা যায়। কারো অ্যাপস বানানোর প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করলে তিনি বানিয়ে দেন। ফরহাদের ফেসবুক আইডি ‘Rayhan Uddin Farhad’। এখানে বা মেইল [email protected]যোগাযোগের ঠিকানা। ব্যক্তিগতভাবে ফরহাদ দেশের বেশ কয়েকজনের অ্যাপস তৈরিতে কাজ করছেন। এ ছাড়া সময় পেলেই ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলাতে ক্লাইন্টের অফার অ্যাপ্রুভ করেন। সেখান থেকেও তার আলাদা ইনকাম হয়।

আসছে নতুন অ্যাপস ‘Life Guide’

তার নতুন আরেকটি অ্যাপস শিগগিরই আসছে। নাম ‘খরভব এঁরফব’। এই অ্যাপসে নিজের মতো করে দৈনন্দিন কাজের রুটিন তৈরি করা যাবে। প্রতিদিন ওই কাজটি করছেন কি না হ্যাঁ, না এ রকম অপশন থাকবে। যেকোনো একটিতে ক্লিক করলে তা মাসিক টার্গেটের সঙ্গে অ্যাড হবে। অ্যাপস রেজিস্ট্রেশন করার সময় আপনার কাছ থেকে মাসিক লক্ষ্য ও টার্গেট করা কাজ জেনে নেওয়া হবে। প্রত্যেক দিনের আপনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রোগ্রামাটিক্যালভাবে আপনার লক্ষ্যের দিকে কতটুকু এগিয়ে যাচ্ছেন তা দেখানো হয়, যা একজন মানুষের জীবনকে আরো শৃঙ্খল করতে সহযোগিতা করবে। শিগগিরই অ্যাপসটি প্লেস্টোরে আসবে বলে জানান।

অ্যাপস নিয়ে কিছু কথা

ফরহাদ জানান, অ্যাপস তৈরি করতে ল্যাপটপ থেকে ডেস্কটপ কম্পিউটার উত্তম। ৮-জিবি র‌্যাম আর একটা এসএসডি লাগিয়ে নিলেই হলো। পাশাপাশি যিনি অ্যাপস বানাবেন তাকে ইংরেজিতে দক্ষতা এবং কম্পিউটারের বেসিক জানতে হবে। প্রয়োজন ধৈর্য আর সমস্যা সমাধানের সাহস। দুটি গ্রুপে, ব্যক্তিগতভাবে ফরহাদ নতুনদের পরামর্শ দেন। ভবিষ্যতে মানুষের সহায়তার জন্য নিজেই গ্রুপ খুলবেন বলে জানান। কী ধরনের অ্যাপস বানাবেন। তার ওপর কত সময় লাগবে সেটা নির্ভর করে। একটা ফুড ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস তৈরি করা যায় ৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে। ফিচার বেশি হলে সময় আরো বেশি লাগবে। ফরহাদ জানান, ইসলামিক, ফুড এবং শপিং টাইপের অ্যাপসের ব্যবহারকারী বেশি। প্লেস্টোরে অ্যাপস রাখতে মাসিক কোনো চার্জ দেওয়া লাগে না। তবে প্রথম অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করতে সামান্য কিছু ডলার দিয়ে কনফার্ম করতে হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় তিন হাজার টাকার বেশি লাগে না। এরপর থেকে ফ্রিতে অ্যাপস পাবলিশ করা যায়।

হাল ছেড়ো না বন্ধু

আনন্দের সঙ্গে কাজ করুন। আপনি একজন ম্যাজিশিয়ানের মতো করে মানুষের জীবনকে মুহূর্তে সহজ করে দেওয়ার মতো কাজ করতে পারবেন। ধৈর্যহারা, হতাশ হওয়ার মতো পরিস্থিতি আসতে পারে। এগুলো সামলে নিতে হবে সুদিনের আশায়। আমার নিজেরই প্রাথমিক অবস্থায় একটা ঊৎৎড়ৎ ংড়ষাব করতে বিশ দিনের বেশি সময় লেগেছিল। আমি হাল ছাড়িনি। হাল ছাড়িনি বলেই এতদূর আসতে পেরেছি- বলেন ফরহাদ।

জনপ্রিয় অ্যাপস রক্ত লাগবে

‘রক্ত লাগবে’। ফরহাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অ্যাপ। যেখানে চাহিদা অনুযায়ী মুহূর্তেই রক্ত পাওয়া যাবে অনায়াসে। পরিবারের নিকটতম কোনো মানুষ অসুস্থ? এখনই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন রক্তের। কোথাও মিলছে না রক্ত। রক্ত লাগবে অ্যাপসে ঢুকলেই পাওয়া যেতে পারে রক্ত। যার রক্ত প্রয়োজন হবে, ওই ব্যক্তি অ্যাপসে ঢুকেই ‘ডোনার চাই’ অপশনে ক্লিক করে যাবতীয় তথ্য দিয়ে সাবমিট করলে অ্যাপসে রেজিস্ট্রারকৃত ডোনারদের কাছে ফোন নম্বর, কোন গ্রুপের রক্ত প্রয়োজন এবং রোগীর রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যসহ একটি মেসেজ চলে যাবে। ডোনার চাইলে রক্ত দিতে কল করতে পারেন। কী ধরনের ভাবনা মাথায় রেখে এই অ্যাপস তৈরি জানতে চাইলে ফরহাদ বলেন, রক্তের জোগান দেওয়া অ্যাপসটি মূলত মানুষের জীবনটাকে আরো সহজ করার জন্যই তৈরি করা। রক্তের প্রয়োজন হলে যাতে কেউ হতাশ না হয়ে যান। দেশের মানুষকে এটাই বোঝাতে চাই, বাংলাদেশে কোনো মানুষ রক্তের অভাবে মারা যাবে না। এই অ্যাপসে সামান্য বাটন ক্লিক করার মাধ্যমে দেশের লাখো কোটি ডোনারের কাছে একটা মেসেজ চলে যাবে। অ্যাপসটিতে স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তি রক্ত ডোনেট করতে যারা চান তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এতে নিয়মিত রক্ত সম্পর্কিত তথ্য ও যেকোনো আপডেট ডোনারের ডিভাইসে নিয়মিত যেতে থাকবে। বেশি ডোনেট যারা করবেন। তাদের অ্যাপস কর্তৃপক্ষ পুরস্কার প্রদান করে।

মানবকল্যাণ তার স্বপ্ন

ছোটবেলা থেকেই কষ্ট, অভাব, অনটন তার পিছু ছাড়েনি। মানুষের কষ্টগুলো তাই তাকে একটু বেশিই ছুঁয়ে যায়। তাই তার স্বপ্ন মানবকল্যাণে ভবিষ্যতে এমন অ্যাপস তৈরি করবেন, যা মানুষের জীবনকে খুব সহজ করে দেবে। ক্লিকে ক্লিকে মিটবে প্রয়োজন। খুঁজে পাবেন দরকারি সব তথ্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close