বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী 

  ০৯ অক্টোবর, ২০২৩

টিকে থাকুক দেশীয় মাছ

চিরায়ত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান যেন কল্পণার কোনো গল্প হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যগুলো এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। একইভাবে খাল-বিল, হাওর-বাওড়, নদীতে সঠিক পরিবেশ না থাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। একসময় গ্রাম বাংলায় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, হাওর-বাওড়ে পানি কমতে থাকলে দেশী মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। বর্ষাকালে ধানের জমিতে জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক এলাকা থেকে। একসময় দেশী বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন কৈ, শিং, মাগুর, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, চাঁন্দা, খলিসা, ডানকিনা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, টাকি, শোল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চ্যাং, চিতল, গতা, পোয়া, বেলে, উপর চকুয়া, কাকিলা, গুতুম, বৌরানীর আগমনে গ্রাম-গঞ্জের মাছের বাজারগুলো মুখরিত হয়ে উঠত। এখন আর সেসব মাছ খুব বেশি একটা দেখা মেলেনা। জেলেদের জালেও তেমন ধরা পড়ে না। 

দেশ থেকে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ বাজার থেকে ‘প্রায় নেই’ হয়ে গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, হারিয়ে যাওয়া দেশী প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াইশ’র বেশি। তাই হাটবাজার, পুকুর, খাল, বিল কোথায়ও এখন মিঠাপানির বহু সুস্বাদু মাছের দেখা মিলছে না। দেশী মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে চাষের পাঙ্গাস, কৈ, শিং, মাগুর, পাবদা, টেংরা, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে চাষের মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। নদীতে পানি না থাকায় আর খাল-বিল লিজ দেওয়ায় অনেক মৎস্যজীবীরাও বদলে ফেলেছেন তাদের পেশা। তাই গ্রামের মাছ বাজারের ক্রেতারা জানায় আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না। কেনার মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ কেনা হত। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ির সামনে খালে বা নদীতে চলে যেত। খালে, পুকুরে তখন এত মাছ ছিল যে, পানিতে নেমে খালি হাতেও মাছ ধরা যেত। এখন দেশী মাছ বাজারে নেই বললেই চলে, তবে যা আছে তা নূন্যতম ৮০০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। 

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশীয় মাছ ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত অনেকগুলো কারণই দায়ী। এরমধ্যে জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশী রাক্ষুসে মাছের চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব কারণেই ৫০ টির বেশি দেশী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। একই সঙ্গে পোনা আহরণ, নেটজাল ও মশারি জাল ব্যবহার করে খালে-বিলে মাছ ধরার কারণেও দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

হারিয়ে যাওয়া দেশী মাছ রক্ষায় ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বিলুপ্ত হওয়া প্রায় ৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ এখন বিশেষ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। তাছাড়া নদী-হাওর-বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ এবং মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে মৎস্য হ্যাচারিগুলোও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশী মাছের পোনা উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন মাছ চাষের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারকেও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় মাছের স্বাদণ্ডগন্ধ পুনরুদ্ধার করা যায় কি-না, তারও গবেষণা হওয়া উচিত। 

উদ্বেগের বিষয়, বর্তমানে চাষ করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছে বিরক্তিকর গন্ধের উপস্থিতি ভোক্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, সামুদ্রিক পচা মাছ, ট্যানারির বর্জ্যসহ ক্ষতিকর ধাতু মেশানো হয় মাছের খাবারে। বিষাক্ত এই খাবারে বেড়ে ওঠা মাছ খেলে মানবদেহে নানা জটিল রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। জানা গেছে, বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো মাছের খাবারের সঙ্গে মাছ দ্রুত বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। মাছ মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই মাছ চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় যথাযথ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষত মাছের কৃত্রিম খাবার নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে, সেগুলোতে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ আছে কিনা। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব দেশী মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে ও এর উৎপাদন বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এমনটাই প্রত্যাশা। আমাদের হাওর-বাওড়, বিল, জলাশয়ের মিঠাপানি সারা বিশ্বেই একটা অমূল্য সম্পদ। কারণ এই মিঠাপানি বিশ্বে বিরল। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায় কয়েক গুণ। তাই মাছে ভাতে বাঙালী’র ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে গৌরব নিয়ে টিকে থাকুক- এই প্রত্যাশাটুকু করাই যায়। 

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close