এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ

  ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২

স্মারক মুদ্রায় কাতার বিশ্বকাপ

মুদ্রা হচ্ছে মানবজীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা পণ্য বা সেবা আদান-প্রদানের বিনিময় মাধ্যম। মুদ্রা শুধুই বিনিময় মাধ্যম নয়; সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতিরও অংশ। নানা বর্ণের মুদ্রায় সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ গর্বের বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলার রেওয়াজ রয়েছে যুগ যুগ ধরে।

বিশেষ বিশেষ দিন এবং ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে এক বিশেষ ধরনের মুদ্রা জারি করা হয়ে থাকে। এই বিশেষ ধরনের মুদ্রাগুলোকে বলা হয় স্মারক মুদ্রা।

কাতারজুড়ে নয়নাভিরাম সব স্টেডিয়ামে চলছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত আসর বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপ আসরে পুরো পৃথিবী মেতে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে চলছে টানটান উত্তেজনা। বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো জনপ্রিয় উৎসবকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার প্রচেষ্টায় যেন ত্রুটি রাখতে চায় না বিশ্ববাসী। আর তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ স্মারক মুদ্রায় বিশ্বকাপ ফুটবল-২০২২ এর অফিশিয়াল লোগো, ট্রফির প্রতিকৃতি, সকার বল, বল নির্ণায়ক মুহূর্তের রূপক, গোল দেওয়ার পরে খেলোয়াড়ের উদযাপন, অফিশিয়াল মাস্কট (লায়িব), বিভিন্ন স্টেডিয়ামের প্রতিকৃতি ব্যবহার করে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কাতার বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেছে।

জমকালো ও বর্ণিল বিশ্বকাপ আয়োজনের মতো স্মারক আয়োজনেও শীর্ষে রয়েছে কাতার। ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল আয়োজন করে দেশটি যেমন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, তেমনি নিজেদের দেশে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১, ৫, ১০, ২০, ৫০ ও ১০০ রিয়াল অভিহিত মূল্যের কপার-নিকেল, স্বর্ণ ও রূপার ২৪টি নকশার প্রায় ১০ লক্ষাধিক ধাতব মুদ্রা (কয়েন) ইস্যু করেছে দেশটি। ২২ রিয়াল মূল্যমানের একটি ব্যাংক নোটও জারি করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কাতারের এসব ধাতব মুদ্রার মুখ্য পিঠে উপস্থাপিত হয়েছে ট্রফি, মাস্কট (লায়িব), আয়োজক দেশ হিসেবে কাতারের মানচিত্র, বিখ্যাত লুসাইল স্টেডিয়াম, গোল প্রদানের মুহূর্ত, গোল উদযাপনসহ ফুটবল বিশ্বকাপ সংক্রান্ত নানাবিধ প্রতিকৃতি।

আর প্রতিটির গৌণ পিঠে অঙ্কিত হয়েছে কাতারের জাতীয় প্রতীক। যেখানে রয়েছে গুণ চিহ্নের আদলে দুটি বাঁকা তলোয়ার, ‘ধো’ নামীয় ঐতিহ্যবাহী পালতোলা জাহাজ ও একজোড়া পাম গাছ। তার ওপরে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ-২০২২ এর অফিশিয়াল লোগো।

২২ রিয়াল মূল্যমানের ব্যাংক নোটটির একদিকে লুসাইল স্টেডিয়াম এবং অন্যদিকে আল বায়েত স্টেডিয়ামের ছবি স্থান পেয়েছে।

কাতারের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ফুটবল মহারণের এ আয়োজনে পিছিয়ে নেই ওশেনিয়া অঞ্চলের প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। এই দীপ রাষ্ট্রটি অভিনব আকৃতি, রং আর নকশার স্মারক মুদ্রা প্রচলনে বরাবরই সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছে। তার ব্যতিক্রম হয়নি এ আয়োজনেও। রাষ্ট্রটি সরাসরি সকার (ফুটবল) বলের আদলে ১০ ডলার অভিহিত মূল্যের ২০২২টি রঙিন স্মারক রৌপ্যমুদ্রা ইস্যু করেছে। যার একপাশে কাতার বিশ্বকাপের অফিশিয়াল লোগো এবং অপর পাশে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতিকৃতি খোদিত হয়েছে। দেশটি অস্বাভাবিক আকৃতির ২৯৯টি রৌপ্য মুদ্রাও ইস্যু করেছে। যার প্রতিটির ওজন ১ কেজি করে! এছাড়াও ৫ ডলার অভিহিত মূল্যের আরেকটি রঙিন রোপ্যমুদ্রা জারি করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ মুদ্রাটির মুখ্য দিকে স্থান পেয়েছে গোল্ড প্লেট করা বিশ্বকাপ ট্রফি এবং গৌণ দিকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুখাবয়ব।

বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বেই এ মহোৎসবের সম্মানার্থে ২০২১ সালেই স্পেন, ফ্রান্স, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা, আজারবাইজান ও কাজাখস্তান বিভিন্ন অভিহিত মূল্যের স্বর্ণ ও রৌপ্য স্মারক মুদ্রা ইস্যু করেছে। এসব মুদ্রাতেও স্থান পেয়েছে কাতার বিশ্বকাপের অফিশিয়াল লোগো, সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় বা মর্যাদাবাহী নকশা, ফুটবলের প্রতিকৃতিসহ ফুটবল সংশ্লিষ্ট নানাবিধ নকশা।

এভাবে স্মারকের মাধ্যমে বিশ্বকাপের আমেজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এবং বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখার প্রথা এবারই প্রথম এমনটা নয়।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ও বিশ্বকাপ ফুটবলের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ-২০১৮ উদযাপন উপলক্ষে রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, সলোমান দ্বীপপুঞ্জসহ অসংখ্য দেশ মনকাড়া সব ডিজাইনের স্বর্ণ, রৌপ্যসহ বিভিন্ন ধাতব ও কাগজি স্মারক মুদ্রা বাজারে ছেড়েছিল।

সেসব মুদ্রাতে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ-২০১৮ এর লোগো, বিশ্বসেরা বিভিন্ন ফুটবলারের প্রতিকৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়াবলি স্থান পেয়েছিল।

এ তো গেল শুধু ২০১৮ বিশ্বকাপের কথা... বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১১ এর আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় রীতিমতো ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের স্মারক রৌপ্যমুদ্রা অবমুক্ত করে বসে নিজ দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেট-২০১১ কে স্মরণীয় করে রাখতে।

মুদ্রাটির একপিঠে ওপরে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ-২০১১ এর অফিশিয়াল লোগো এবং লোগোর নিচে ‘আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাংলাদেশ-২০১১’ কথাটি লেখা হয়। অন্য পিঠে বিশ্বকাপ ক্রিকেট-২০১১ এর ট্রফির ছবি, বাংলা ও ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ এবং ‘১০ টাকা’ কথাগুলো মুদ্রিত হয়।

এসব স্মারক মুদ্রা ও নোট সাধারণভাবে

বিনিময়যোগ্য নয়। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট দেশে বেড়াতে গেলে তাদের এসব মুদ্রা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। মূলত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ঘটনাগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতেই গ্রহণ করা হয় এমন উদ্যোগ। তবে যেকোনো নাগরিক শখের বশে এই ধরনের মুদ্রা নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে সংগ্রহ করতে পারে।

বর্তমান সময়ের মতো সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা বিশেষ কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান, রাজ্য বিজয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে এক ধরনের বিশেষ মুদ্রা জারি করত। এই মুদ্রাগুলো অনিয়মিতভাবে জারি করা হতো এবং এতে নির্দিষ্ট বিষয়ের কিংবা ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক অঙ্কিত থাকত। প্রাচীন গ্রিসে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার সময় বিশেষ এক ধরনের মুদ্রা জারি করা হতো। গ্রিসের সাইরাকিউসে ডেকাণ্ডদ্রাকমা নামক এক ধরনের মুদ্রা পাওয়া গেছে। যার আনুমানিক সময়কাল ৪০০ খ্রি. পূর্বাব্দ। এই মুদ্রাগুলো শাসকের অন্যান্য মুদ্রার মতো নিয়মিতভাবে জারি হয়নি। সাইরাকিউস ছাড়াও উক্ত মুদ্রাগুলো এথেন্স, মিসর ও কার্থেজে পাওয়া যায়। এই মুদ্রাকেই পৃথিবীর প্রথম স্মারক মুদ্রা বলা হয়। স্মারক মুদ্রা এবং ডাকটিকিট সংশ্লিষ্ট দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং নির্দিষ্ট সময়ের সাক্ষী। এগুলোর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া সময় ও অতীতকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close