আলমগীর খোরশেদ

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৩

গ্রামীণ ঐতিহ্য

বাড়ির বছরি মুনি বা কামলা

গ্রামীণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারে যাদের জন্ম, কেটেছে শৈশব, কৈশোর থেকে তারুণ্যবেলা, গ্রামের ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে, দেখেছে রান্নাঘরের পাশে সবুজ লাউগাছটা পাটশোলার মাচায় তার আকর্ষি পেঁচিয়ে তির তির করে বিস্তার করছে সবুজ রাজত্ব। নতুন ধানের মাড়াই, ধান কাটা, হালের গরু, গাভি, বাছুর দেখাশোনা করা, সন্ধ্যায় গোয়ালঘরে গরু দেওয়া, ভোরে বের করা, গৃহস্থালি সব কাজ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে গৃহস্থরা একজন কাজের লোক রাখতেন। গ্রামের ভাষায় তাকেই মুনি বলা হতো। অবস্থাভেদে মুনি হতো তিন মাস মেয়াদি, ছয় মাস মেয়াদি অথবা বারো মাস বা এক বছর মেয়াদি।

অঘ্রাণের ধান কাটার জন্য রুজিনা কামলা রাখত গৃহস্থ। এসব কামলা দূর থেকে আসতেন কাজ করার জন্য। গ্রামের কোনো বাজার, রাস্তার মোড়, কড়ই, রেন্ট্রি, বটগাছের নিচে খুব ভোরে বসত কামলা বাজার। গৃহস্থকর্তা নিজে যেতেন কামলা আনতে। কাছাকাছি হলে হেঁটে, দূর হলে সাইকেল চালিয়ে। অভাবতাড়িত গ্রামের অসহায় মানুষ তার কিশোর বয়সের ছেলেটাকেও রুজিনা কিংবা মাসিক কামলা হিসেবে দিয়ে দিত। মাসিক বা বছরি মুনি হিসেবে তাদের রাখতেন গৃহস্থরা। বাংলা পঞ্জিকা মতে হিসাব হতো বাড়িতে গৃহস্থালি কাজের জন্য রাখা মুনিদের কাজের শর্ত, বেতনসহ সব আদ্যোপান্ত। মুনি শর্তানুযায়ী বছর শেষ না হতেই টাকা নিলে তা বড় নোট খাতায় লিপিবদ্ধ রাখা হতো, যা বছর শেষে তার মাইনা থেকে কেটে রাখার জন্য।

রুজিনা কামলার লোকজন কাঁধে কাপড়ের পুঁটলা, ধান কাটার কাঁচি, ছোট একটা কাঁথা, গামছা নিয়ে আসতেন গৃহস্থ বাড়িতে। তাদের বাড়ি দূরে তাই গৃহস্থ বাড়ির কাছারিঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হতো। কাছারিঘর বা আলগা ঘরে পেতে রাখা বড় চৌকিতে ধানের খড় বিছিয়ে তাতে থাকতেন দূর থেকে আসা রুজিনা কামলারা। তাদের পরিচালনা করার কাজটি করত বছরি মুনি। তিন মাস, ছয় মাস কিংবা এক বছরের জন্য কাজে আবদ্ধ হতেন মুনি লোকটা। অনেক সময় গৃহস্থের সঙ্গে সমঝোতায় পারিশ্রমিকের সঙ্গে বছরি মুনিকে জমিও দেওয়া হতো, যার অর্ধেক ফসল মুনি ও বাকি অর্ধেক গৃহস্থ নিয়ে নিতেন। সিজনাল কামলারা দীর্ঘদিন গৃহস্থ বাড়িতে থাকায় অনেকে অসুস্থ হয়ে যেতেন। বাড়ির কর্তাগিন্নি মুনিকে নিয়ে নারকেলগাছ থেকে ডাব পেড়ে এনে সঙ্গে সঙ্গেই অসুস্থ লোকটাকে খাইয়ে দিতেন। পাড়ায় থাকা কবিরাজের বাড়ি থেকে বটিকা খাইয়ে দিতেন, গাছগাছালির রস চেঁছে দিয়ে। আট-দশ দিন পর কোনো কামলা তার নিজ বাড়িতে যেতে চাইলে হিসাব অনুযায়ী টাকা দিয়ে দিতেন গৃহস্থকর্তা।

গৃহস্থকর্তার ধান রোপণে জমি তৈরি করতে পানি দেওয়া জমি চারটা হালের পর মই দিয়ে ধান রোপণের জন্য প্রস্তুত করতে হতো। এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় খেত ‘হামাল দেওয়া’ বলে। হামাল দিতে চারবার হাল চাষের কাজটি টাকা ছাড়া, শুধু খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ভালো রান্না করে খাওয়ানো হতো। এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘বেগার খাওয়া’ বলে। গৃহস্থ হালওয়ালারা সারা দিন তাদের সুহৃদের জমিতে চাষ দিয়ে পরিশ্রম করে রাতে সবাই গৃহস্থ সুহৃদের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে আসতেন। কেউ কেউ তাদের ছোট সন্তানকে নিয়ে আসতেন খাবারের জন্য। সেই রাতটা ছিল খুব আনন্দময়। হালওয়ালা গৃহস্থ বন্ধুরা সবাই মিলে কাজটা করে দিত।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার জন্য জমিতে কাজ করা কামলা নিয়ে গৃহস্থকর্তা চলে আসতেন বাড়িতে।

মুনি বাইরে থেকে অন্দর মহল পর্যন্ত অনায়াসে যাতায়াত করতেন। ছিল বাড়ির সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক। সবার ফরমাশ পালনকারী বছরি মুনি ব্যস্ত থাকতেন গরু নিয়ে। তখন মাঠ থেকে আসা কামলাদের দুপুরে খাওয়ানো, মানে ভাত, তরকারি, পানি আনা-নেওয়ার কাজটি বাড়ির ছোটদের করতে হতো। সবাইকে খাওয়ানোর পর খেতে বসতেন বছরি মুনি। বর্ষাকালে একটানা বৃষ্টি হতো, কোনো থামাথামি নেই। ছয়-সাত দিন পেরিয়ে যেত বৃষ্টি আর বৃষ্টি। গৃহস্থ পরিবারে চাল ফুরিয়ে যেত। বৃষ্টির ভেতর মুনি গোলা থেকে ধান নামিয়ে চুলায় বড় কড়াইয়ে তাপ দিতেন, এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় ধান ‘উঁচ্চেয়া’ বলে। তারপর ‘উঁচ্চানো’ ধান ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল করে রান্না বসিয়ে খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে যেত, পুরো কাজটিতেই মুনির প্রয়োজন হতো। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার কাজও। মধ্যরাত হোক, দিনের বেলায় হোক ডাক দিলেই হাজির, সে হলেন মুনি। ঢেঁকিতে কোনো সমস্যা হলে মুনি ধান মাথায় করে অথবা সাইকেলের ডান্ডার ভেতর বস্তা বসিয়ে নিয়ে যেতেন মেশিনে, ধান ভাঙানোর জন্যও। তখন ধান ভাঙানোর মেশিন সব গ্রামে ছিল না।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close