ড. আফরোজা পারভীন

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৩

গল্প

টিপ

শফিক দ্বিতীয় বিয়েটা সেরেছে একেবারেই ছোট আকারে। আত্মীয়স্বজনের বাইরে তেমন কাউকে দাওয়াত করেনি। সমালোচনা করতে পারে, বাজে কথা বলতে পারে- এমন কাউকে ডাকেনি। বুদ্ধিটা মায়ের। মা বলেছিল,

: আজকালকার লোকজন তো ভালো না। মুখে লাগাম নেই। বেফাঁস কিছু বলে ফেললে নতুন বউসহ ওদের আত্মীয়দের খারাপ লাগবে। তার চেয়ে ভালো- যাদের না ডেকে পারা যায় না তাদের ডাকা।

শফিক অবশ্য বোঝে না সমালোচনা করার কী আছে। কী নিয়ে সমালোচনা করবে লোকজন। বিয়ের পর অনেক খুশি ছিল শফিক আর মিতু। সর্বাংশে সুখী দম্পতি। সবাই তাই বলত। ওরা একসঙ্গে বেড়াত, সিনেমা দেখত, রেস্টুরেন্টে খেতে যেত। কোনো ব্যাপারেই মতভেদ ছিল না ওদের। শফিকদের একান্নবর্তী পরিবার। শফিকের মা-বাবা পুত্রবধূকে নিয়ে সুখী ছিলেন। বউ রান্না করে, ঘর গুছায়, নিয়ম করে ওষুধ দেয়, তাদের যত্ন নেয়। আজকালের দিনে এমন বউ পাওয়া যায় না। শফিকের বোনরাও ভাবি অন্তঃপ্রাণ ছিল। ননদদের কিছুই অদেয় ছিল না মিতুর। মিতুর প্রশংসায় শতমুখ ছিল সবাই। বিয়ের তিন বছর পার হলো হাসি-আনন্দে। এবার সবাই একটা সন্তানের প্রত্যাশা করছিল। সে আকাঙ্ক্ষা শফিক মিতুরও ছিল। এমন সময় ঘটে গেল বিপর্যয়। অসুখে পড়ল মিতু। প্রথমদিকে শফিককে কিছুই জানায়নি মিতু। এই এক স্বভাব মিতুর। নিজের ব্যাপারে জানিয়ে বিব্রত করতে চায় না কাউকে। সামান্য অসুখ একসময় বড় আকার নিল। তারপর একরাতে নিঃশব্দে চলেও গেল।

সেও তো অনেক দিন হলো!

মিতু টিপ খুব ভালোবাসত। ওর ছোট্ট সুন্দর কপালে সব সময় জ্বলজ্বল করত একটা টিপ। সে টিপ যেন ওর সৌন্দর্য শতগুণ বাড়িয়ে দিত। শফিক প্রায়ই মিতুর জন্য টিপ কিনে আনত। মিতু প্রথমদিকে খুশি হলেও শেষ দিকে রাগ করে বলত,

: টিপে আমার বাস বোঝাই হয়ে গেছে। আর কত টিপ কিনবে? আর কিনো না। এবার আমার বিলাতে হবে।

: একদম না, আমার আনা টিপ কাউকে দেওয়া চলবে না। যদি কাউকে দিতে চাও বলবে। আমি আলাদা করে আনব।

মিতু হাসত।

: তুমি বড় হিংসুটে। এত টিপ আমি কী করব?

: পরবে। সকালে এক রকম, দুপুরে এক রকম, বিকেলে এক রকম, রাতে এক রকম।

: পরে কাকে দেখাব? তুমি তো থাকো না বাসায়।

: দেখানোর জন্য পরবে কেন। নিজে দেখবে। ভালো লাগে বলে পরবে।

টিপ নিয়ে ওদের খুনসুটি লেগেই থাকত। মিতুর বারবার বারণ সত্ত্বেও শফিক টিপ আনা বন্ধ করত না। এ নিয়ে বোনরা মজা করত। মা মুখ টিপে হাসতেন। আব্বার সঙ্গে আড়ালে হাসাহাসি করতেন। শফিক সবই বুঝত। কিন্তু টিপ কেনা বন্ধ করত না।

মিতু প্রতিদিন শোয়ার আগে টিপটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় লাগিয়ে রাখত। আয়নার একটা অংশ টিপে ভরে গিয়েছিল। শফিক মনে মনে হাসত। এত দিন সে জানত, আয়নার একটাই কাজ নিজেকে দেখা। এখন আর একটা কাজ আবিষ্কার হলো, টিপ রাখা।

মিতুর আকস্মিক মৃত্যুর পর স্থবির হয়ে পড়েছিল পুরো পরিবার। কিন্তু শোক কেউই বেশিদিন বহন করতে পারে না। একসময় শোক কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল ওরা। শফিক নিয়মিত অফিস করতে লাগল। মা রান্না আর আব্বা বাজারঘাট। বোনরা ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে এলো। ওরাও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে যেতে লাগল। এমন সময় এক দিন ছোট বোন চম্পা চেপে ধরল শফিককে।

: অনেক দিন তো হলো ভাইয়া, এবার বিয়ে করো।

: বলছিস কী তোরা! বিয়ে করব মানে?

: বিয়ে করব মানে মেয়ে করবি। ভাবিকে আমরা সবাই ভালোবাসতাম। ভাবি চলে যাওয়ায় সবাই কষ্ট পেয়েছি! কিন্তু তোরও তো একটা জীবন আছে বল। তোর বয়স কম। মেজবোন টুম্পা বলল।

: ওকে একটু বুঝিয়ে বল তোরা। আমরা আর কদিন। বংশধরও তো দরকার। মা যোগ করলেন।

অনুরোধ উপরোধ মান অভিমান চলল দিনের পর দিন। একসময় রাজি হলো শফিক। মা ও বোনরাই বিয়ে ঠিক করল। মেয়ের বাবা নেই। ভাইয়ের সংসারে আছে। অবস্থা তেমন ভালো নয়। বিয়ের আগে ওদের দেখা করার ব্যবস্থা করল বোনরা। নিজেরো একটু কথা বলে বুঝে-শুঝে নিক।

হবু কনের নাম ঝরনা। ঝরনার মতোই কলকলিয়ে কথা বলে। যেন চোখণ্ডমুখ সারা দেহ দিয়ে ফুটে বের হয় সে কথা। দেখতে সুশ্রী। খানিকটা মোটার দিকে ঘেঁষা। কপালে জ্বলজ্বল করছে একটা টিপ। শফিক টিপটার দিকে তাকিয়ে রইল। ঝরনা বলল,

: কী দেখছেন?

: না মানে আপনি আমার আগের স্ত্রী মিতুর কথা তো জানেন। ও সব সময় টিপ পরত। টিপে ওকে খুব সুন্দর লাগত! আপনাকেও দারুণ লাগছে। আমি আপনাকে অনেক টিপ কিনে দেব।

: ওকে অনেক টিপ কিনে দিতেন বুঝি?

: হ্যাঁ, জানেন টিপ কেনা নিয়ে আমাদের প্রায়ই ঝগড়া হতো।

এরপর সেসব মিষ্টি খুনসুটির গল্প করতে লাগল শফিক।

ঝরনার মুখ গম্ভীর হতে থাকল। একসময় তার মুখের কল্লোলিত ঝরনাধারা থেমে গেল। শফিক কিছুই বুঝল না। এরপর আর কথা এগোল না। ওরা যার যার বাড়ি ফিরে গেল।

২.

একেবারেই অনাড়ম্বর বিয়ে হলো। কন্যাপক্ষ যেন মেয়ে বিদায় করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। না দিল কোনো ভালো শাড়ি, না গহনা। শফিকরা কিছুই বলল না। বাপ মরা মেয়ে! ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। দেবে কোত্থেকে। শফিকরাই সব দিয়ে থুয়ে আনল।

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এলো ঝরনা। বিয়ের সজ্জা ছেড়ে মুখহাত ধুলো। শফিক বলল,

: কপালে একটা টিপ পরো। আমি নতুন টিপের পাতা এনে রেখেছি।

সে পাতাটা ঝরনার দিকে এগিয়ে দিল।

: আমি কখনোই টিপ পরি না। ওদিন আমার খালাতো বোন জোর করে পরিয়ে দিয়েছিল।

শফিকের মুখে আঁধার নেমে এলো। ও টিপের পাতা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসে চুল আঁচড়াতে লাগল ঝরনা। ওর চোখ পড়ল আয়নায় লাগিয়ে রাখা অসংখ্য টিপের ওপর। কপাল কুঁচকে উঠল। ও ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে এলো। বিছানায় বসে ছোট আয়নায় চুল আঁচড়াতে লাগল। শফিকের কিছুই খেয়াল করল না। দুদিন পর বাড়িতে একটা নতুন ড্রেসিং টেবিল এলো।

মা অবাক হয়ে বললেন-

: বউমা হঠাৎ ড্রেসিং টেবিল কেন?

: বিয়েতে আমার মা-ভাইয়ের উপহার।

মা অবাক হয়ে ভাবলেন, খাট-পালং ওয়ারড্রব কিছুই না, শুধু ড্রেসিং টেবিল কেন?

মার মনের কথা বোধকরি বুঝে ফেলল ঝরনা। বলল,

: আমি তো ড্রেসিং টেবিল খুব ভালোবাসি। ড্রেসিং টেবিল ছাড়া কাপড় পরতে পারি না, চুল বাঁধতে পারি না। তাই।

: একটা ড্রেসিং টেবিল তো ছিলই। এটা বেশি পুরোনো না। বিয়ের পর শখ করে মিতু বানিয়েছিল। শুধু শুধু ওনাদের পয়সা খরচ করালে।

: এই ডিজাইনটা আমার পছন্দ তাই।

ড্রেসিং টেবিলটা জায়গায় বসানো হলো। আগের ড্রেসিং টেবিলটা সরিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো গ্যারেজে। মায়ের ইচ্ছে ছিল না। বলেছিলেন বারান্দায় রাখতে। ঝরনা বলল,

: বারান্দায় এমনিতেই চলাফেরার জায়গা নেই মা। শফিক তখন অফিসে।

অফিস থেকে ফিরে শফিক দেখল ঘরে ঝকঝক করছে নতুন একটা ড্রেসিং টেবিল। সে টেবিলের সামনে বসে চুল বিন্যাস করছে ঝরনা। কণ্ঠে গুণগুণ গান। ও ঘরে ঢোকামাত্র ঝরনা বলল,

: দেখো তো কেমন হয়েছে? খুব সুন্দর না!

: সুন্দর! কিন্তু এটা এলো কোথা থেকে?

: বিয়েতে মা-ভাইয়ের উপহার।

: কেন?

: উপহারের আবার কেন কি?

একই প্রশ্ন শফিকের মনেও এলো। শুধু ড্রেসিং টেবিল কেন?

: আগেরটা?

: যেখানে পুরোনো জিনিস থাকার কথা। গ্যারেজে।

: আর টিপগুলো?

: পুরোনো ড্রেসিং টেবিল যেখানে থাকবে পুরোনা টিপও তো সেখানে তাই না?

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close