নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ মার্চ, ২০২৩

আ.লীগ মহানগর দক্ষিণে বিতর্কিতদের দৌড়ঝাঁপ

অর্থের বিনিময়ে পদ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের কমিটি গঠনে ২০ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সময় বেশি না থাকায় কমিটি গঠনে চলছে তোড়জোড়। এই সুযোগ কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছেন বিতর্কিত নেতারা। অর্থের বিনিময়ে পদ বাগিয়ে নিতে লবিং করছেন অনেকে এমন অভিযোগ উঠেছে। ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে কমিটি গঠনে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দলের ত্যাগী ও যোগ্য নেতারা।

সাংগঠনিক সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার (৮ মার্চ) দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সময় অনুযায়ী কমিটি করতে না পারায় মহানগরের নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কমিটি গঠন করতে তিনি ২০ মার্চ সময় বেঁধে দিয়েছেন।

তারিখ বেঁধে দেওয়ার পর থেকে মহানগর দক্ষিণের বিতর্কিত নেতারা আবারও তৎপর হয়ে উঠেছেন। এমনকি টাকার বিনিময়ে হত্যা মামলার আসামি, চাঁদাবাজ, রাজাকারের সন্তান, নব্য আওয়ামী লীগার, বিত্তশালী যুবদল নেতা এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে অভিযুক্ত হয়ে বহিষ্কৃত নেতাদের দিয়ে খসড়া কমিটি করার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ মহানগরের নেতাদের।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণের ৪০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন মাদক মামলার আসামি ফায়দুল ইসলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেন্ডারিয়ার শরৎগুপ্ত রোডে তানাকা কোম্পানির একটি বাড়িতে আনসার ক্যাম্প বসানো হয়। ওই বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফায়দুল ইসলাম। বাড়িটি মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত স্থানীয় পর্যায়ে। ২০১৫ সালের ২ জুলাই ওই বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখানে ২১ হাজার ইয়াবা, ৩০০ গ্রাম হেরোইন, ১১২ বোতল ফেনসিডিল ও বিভিন্ন মাদক পাওয়া যায়। ফায়দুল ইসলাম পালিয়ে যান। পরে র‌্যাব তার নামে মামলা করে। মামলা এখনো চলমান এবং এর প্রমাণ প্রতিদিনের সংবাদের হাতে এসেছে।

এর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪০নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান ফায়দুল ইসলাম। এলাকাবাসী জানান, নির্বাচনে হারার পর থেকে অস্ত্রধারী লোকজন নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘোরাফেরা করেন তিনি। ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ করে সে সময় ফায়দুল ইসলাম ৪০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি হয়ে যান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অন্তর্গত ৪০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য অর্ধ কোটি টাকার লেনদেনের খবর স্থানীয় নেতাকর্মীদের মুখে মুখে ফেরে।

মহানগরীর অনেক নেতাই বলেছেন, স্বজনপ্রীতি এখন মহানগরীর রাজনীতিতে ওপেন সিক্রেট। মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মন্নাফী তার ছেলে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ গৌরবকে ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আনতে চাচ্ছেন। আর একই থানার সভাপতি করতে চাচ্ছেন আরেক কাউন্সিলর মনোয়ার হোসেন আলোকে। দুজন এরই মধ্যে নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত। তা ছাড়া কেন্দ্র থেকেই ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে না আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। ফলে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই এ দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদ পাওয়ার সুযোগ নেই।

একইভাবে ওয়ারী থানার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি হতে চান মন্নাফীপুত্র গৌরবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাবেদ হোসেন মিঠু। সদরঘাট এলাকায় তার নামে অভিযোগের শেষ নেই। মিঠু এবং তার ভাই যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত জাভেদ হোসেন পাপন এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার পলাতক আসামি ফ্রিডম মানিকের ঘনিষ্ঠ আলী রেজা খান রানার নাম পল্টন থানার ১৩ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি পদ পেতে লড়ছেন। এই রানা শান্তিনগরের ব্যবসায়ী পাভেল ও তৎকালীন ১১ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওছার হত্যা মামলার অন্যতম এজাহারভুক্ত আসামি। ২০১৩ সালে অবৈধ অস্ত্র, ৮৬ রাউন্ড গুলি, ৪০০ ইয়াবাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি।

অন্যদিকে, মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির তার সহোদর কাউন্সিলর মকবুল হোসেনকে লালবাগ থানার সভাপতি পদে আনতে চাচ্ছেন। চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার আপন ভাগনে বখতিয়ার হোসেনকে পদায়ন করতে চান তিনি। এক সময়কার যুবদল নেতা বখতিয়ারের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। একই থানা কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন শাহীন খান নামে আরেক বিতর্কিত ব্যক্তি।

সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুনের আরেক ঘনিষ্ঠজন শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি পদপ্রত্যাশী ও বর্তমান সভাপতি জি এম আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। সর্বশেষ সম্মেলনে সভাপতি হওয়ার পর থেকেই তিনি পোড়া মার্কেট, পীর ইয়ামেনী মার্কেট, ট্রেড সেন্টার, খদ্দর মার্কেট এবং বঙ্গ মার্কেটে নামে-বেনামে দোকান করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের আলী আহমদকে থানা কমিটিতে রাখার কারণে ক্যাসিনোর ভাগের অর্থও পেতেন তিনি। একই থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোশাররফ হোসেন এবার থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হতে চাচ্ছেন। শাহবাগ এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী থেকে উত্থান হওয়া এই নেতাও বিরুদ্ধে আজিজ সুপার মার্কেটের জায়গা দখল করে হোটেল ব্যবসা, সাধারণ ব্যবসায়ীদের মারধর, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবহার এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।

কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক (ওবায়দুল কাদের) যে সময় দিয়েছেন, এর মধ্যে আমরা ওয়ার্ড ও থানা সভাপতি-সম্পাদকের নাম জমা দিতে পারব। এখন যাচাই-বাছাই চলছে। মহানগর নেতাদের নিয়ে গঠিত টিমগুলো কাজ করছে। তারা প্রার্থীদের বিষয়ে পর্যালোচনা করছেন। সময় হলে কমিটি ঘোষণা হবে।

বিতর্কিত নেতাদের দৌড়ঝাঁপ ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসন অনুযায়ী মহানগরের নেতাদের নিয়ে আমাদের সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির নেতারা পদপ্রত্যাশীদের নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করে আমাদের জানান। যাদের নামে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বিতর্কিতদের বিষয়ে প্রমাণ মিললে কমিটিতে পদ পাবে না। থানা-ওয়ার্ড কমিটিতে সৎ, ত্যাগী, যোগ্য ও স্বচ্ছ ইমেজের লোকদেরই মূল্যায়ন করা হবে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অভিযোগ করে বলেন, যারা টাকা নিচ্ছে বা দিচ্ছে তারাই আবার আমাদের জানাচ্ছে। ভাই, ওমুককে অত টাকা দিয়েছি, তমুকের কাছে অত টাকা নিয়েছি। আমরাও মহানগরের সভাপতি-সম্পাদককে জানাচ্ছি। এখন তারা কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই দেখার বিষয়। তবে বিতর্কিত, মাদকের সঙ্গে যুক্ত অথবা হাইব্রিডরা যেন কমিটিগুলোতে স্থান না পায় সে বিষয়টি আমরা নেতাদের অবহিত করেছি।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আ.লীগ মহানগর দক্ষিণ,বিতর্কিতদের দৌড়ঝাঁপ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close