অর্থনৈতিক প্রতিবেদক:

  ২৪ মে, ২০২৪

ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সিপিডি’র সেমিনার

‘রিয়েল টাইম’ তথ্য নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে

বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওয়েসবাইটে হালনাগাদ তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘রিয়েল টাইম’ (সঠিক সময়ে বা তাৎক্ষণিক) তথ্য পাওয়া যায় না বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘‘হোয়াট লাইস অ্যাহেড ফর ব্যাংকিং সেক্টর অব বাংলাদেশ’’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে এ কথা বলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হালনাগাদ, এমনকি দৈনিক আকারে তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে রিয়েল টাইম তথ্য পাওয়া যায় না। তথ্যর সহজলভ্যতা থাকতে হবে। আগে আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে হালনাগাদ তথ্য জানতে পারতাম। এখন সেখানেও বাধা আসছে। তথ্য যদি ভুল হয়, সঠিক না থাকে, তাহলে নীতি সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।

খেলাপী ঋণের পরিমাণ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ও পুঁঞ্জীভূত নানা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করছে তা যথাযথ না। বাস্তব চিত্র গোপন করা হচ্ছে- এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার। বাস্তবে তা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোও তথ্য প্রকাশ করছে না জনসম্মুখে। দুর্ঘটনা ঘটার পর সবাই জানতে পারছে। আসলে ব্যাংক খাত কতোটা খারাপ, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা খেলাপী ঋণ। এটি বাড়ছে ব্যাংক খাতে সরকার ও ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপে। খাতটিতে জবাবদিহীতা, সুশাসন ও স্বচছতা নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সাময়ীক সময়ের জন্য হলেও ব্যাংক খাত কোন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে ব্যাংক কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট’ এর দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সিডিপি বলেছে, তখন মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এরমধ্যে ঋণ অবলোপন ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা, ঋণ পুনঃতফিল ছিল দুই লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন খেলাপী ঋণ দেখিয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। অথচ ২০১২ সালে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা।

দশ বছরে তা তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। খেলাপী এ ঋণের বাইরে ঋন পুনঃতফসিল, আদালতের নিষেধজ্ঞা ও ঋণ অবলোপন যোগ করলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলায় খেলাপী ঋণের এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা আটকে আছে। সব মিলিয়ে গত ডিসেম্বর শেষে দেশের খেলাপী ঋণের পরিমাণ হচ্ছে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।

তথ্য তুলে ধরে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংক খাতে ইসলমী ব্যাংকগুলোর তারল্য দিন দিন কমছে। মোট তারল্য বাজারে আগে ৩৯ শতাংশ ছিল। মালিকানা বদলের পরে তা ২৫ শতাংশে নেমেছে। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংক খাত ক্রনি ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা ব্যাংকগুলোকে তাদের আর্থিক লক্ষ্য পূরণে অলিগর্ক হয়ে উঠছেন।

গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চিকিৎসক জাহেদ উর রহমান বলেন, সমস্যা ক্যান্সারের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছে। আর্থিক খাত এখন অলিগর্কদের দখলে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা মিলে একটি নেক্সাস(বলয়) বানিয়েছে। এই নেক্সাসের কথায় ঋণ দেয়া হয়, ব্যাংক চলে। দুর্নীতি বন্ধ করতে যদি সরকার চায় তাহলে হবে, না হলে কখনোই হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সমবায় সমিতিতে পরিণত হয়ে গেছে। সমবায় সমিতি যেমন সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চলে, তেমনি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের প্রভাবশালীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে নীতি ঠিক করছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাদের কাজ নীতি তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করা। এখন অর্থনীতি ঠিক করার সময়ে এমন নীতি তৈরি করছে তাতে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ব্যাংক খাতে তথ্য প্রবাহে বাধা এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে মন্তব্য করে সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পাবলিক ফিগার বা পাবলিক ইস্যুতে সব কিছুই স্বচছ ও তথ্যর অবাধ প্রবাহ থাকার পক্ষে আমি। এ বিষয়ে আমি সরকারের উপরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। স্পর্শকাতর তথ্য নাম দিয়ে কিছু তথ্য আড়াল করা হচ্ছে। এভাবে স্পর্শকাতর নাম দিয়ে অন্য কিছু করা হচ্ছে কি না তা দেখা দরকার, সব তথ্যই প্রকাশ করা উচিত। তাহলে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের আলোচনায় অংশীজন হিসেবে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা থাকতে পারেন। কিন্তু তারা থাকেন না। থাকলে ভালো হয়, না থাকায় সরকারের ক্ষতি হচ্ছে, তারা তো অনেক কিছুই জানতে পারতেন।

সিপিডির ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতিতে সচল রেখেছে। উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে এক সময়ে। ব্যাংক খাত সমস্যায় থাকলে অর্থনীতিতে প্রভাব আরো বেশি পড়বে। তিনি সেমিনারে আসা বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব ও সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদন সমন্বয় করে সুপারিশ আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া হবে বলেও জানান।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সিপিডি,ড. ফাহমিদা খাতুন,এম এ মান্নান,ব্যাংক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close